কার্ল হুপার: এক ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির ক্রিকেট জীবন
ক্রিকেট বিশ্বে যখন উজ্জ্বল কিছু নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্ল হুপার। ১৯৮৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে ১০২টি টেস্ট এবং ২২৭টি একদিনের আন্তর্জাতিক (ওডিআই) ম্যাচ খেলেছেন। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং শৈলী এবং কার্যকর অফ-স্পিন বোলিং ছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে দারুণ উপভোগ্য।
শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, বরং নেতৃত্বের গুণাবলী দিয়েও তিনি দলকে বহুবার পথ দেখিয়েছেন, যার প্রমাণস্বরূপ ২২টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন।
গায়ানাতে জন্ম নেওয়া হুপারের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাঁর বাড়ির নিচে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে তিনি খেলার কৌশল রপ্ত করেন। সেই সময়ে ছোট আকারের পিচে খেলার কারণে দ্রুত রান তোলার দক্ষতা তৈরি হয়, যা তাঁর ব্যাটিংয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
১৯৮৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলার সুযোগ পান হুপার। সেই সময়কার কিংবদন্তি ক্রিকেটার, যেমন – ভিভ রিচার্ডস, মার্শাল, হোল্ডিং, এবং জোয়েল গার্নারদের সঙ্গে একই দলে খেলাটা ছিল তাঁর জন্য স্বপ্নের মতো।
তিনি ছিলেন দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য এবং তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন।
ভারতের ইডেন গার্ডেন্সে (কলকাতা) তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। সেই ম্যাচে তিনি স্থানীয় আম্পায়ার এবং প্রায় এক লক্ষ দর্শকের সামনে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “কখনও কখনও এমন কিছু মুহূর্ত আসে যা সহজে পাওয়া যায়, এবং সেই মুহূর্তে উপলব্ধির গভীরতা কমে যায়।”
হুপারের মতে, ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ক্রিকেটে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
দলের অনেক ভালো খেলোয়াড় ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে দলের পারফরম্যান্সে অবনতি হতে শুরু করে। খেলোয়াড়দের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া এবং তাঁদের উপর বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা ছিল অন্যতম কারণ।
হুপার মনে করেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট পিছিয়ে পড়ার একটি প্রধান কারণ হলো আধুনিক ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা।
অন্যান্য দেশের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা এবং আর্থিক দিক থেকে তারা পিছিয়ে পড়েছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আগমনও তাঁদের জন্য একটা বড় ধাক্কা ছিল।
খেলোয়াড়রা এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বেশি আগ্রহী হওয়ায়, টেস্ট ক্রিকেটে ভালো খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে গেছে। শিমরন হেটমায়ার এবং নিকোলাস পুরানের মতো খেলোয়াড়দের টেস্ট ক্রিকেট খেলা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের লোভনীয় অফারগুলো আকৃষ্ট করেছে।
অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর হুপারের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং তাঁর পরিবার সবসময় তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছে।
তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠন করে তিনি তাঁদের মধ্যে ভালো পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে।
তাঁর নেতৃত্বে ক্রিস গেইল, রামনারেশ সারওয়ান, এবং শিবনারাইন চন্দরপলের মতো তরুণ খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রমাণ করতে শুরু করেন।
হুপারের চোখে, ভিভ রিচার্ডস ছিলেন অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। এছাড়া, ওয়াসিম আকরামের বোলিংয়ের তিনি ছিলেন মুগ্ধ।
তাঁর মতে, আকরামের সুইং বোলিং ছিল অসাধারণ, যা ব্যাটসম্যানদের জন্য এক বিভীষিকা ছিল।
ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পাওয়াটাও ছিল হুপারের কাছে স্বপ্নের মতো। কেন্টের হয়ে খেলার সময় তিনি সেখানকার পরিবেশ উপভোগ করেছেন এবং অনেক বন্ধু তৈরি করেছেন।
বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইড স্ট্রাইকার্সের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তরুণ খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
কার্ল হুপারের ক্রিকেট জীবনের এই গল্পটি শুধু একজন খেলোয়াড়ের সাফল্যের কাহিনী নয়, বরং ক্রিকেটের পরিবর্তনশীল বিশ্বে একটি দলের উত্থান-পতন এবং একজন কিংবদন্তির অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান