প্যারিসের পরিত্যক্ত রেললাইন: বন্যপ্রাণী ও পদচারীর জন্য এক সবুজ আশ্রয়স্থল।
প্যারিসের বুকে এক সময়ের ব্যস্ত রেললাইন, যা বর্তমানে পরিণত হয়েছে সবুজ উদ্যান আর প্রকৃতির অভয়ারণ্যে। “পেতিত সিন্তুর” নামে পরিচিত এই পরিত্যক্ত রেললাইনটি এখন শহরের কোলাহল থেকে দূরে, শান্ত ও সবুজে ঘেরা এক জগৎ। উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে পরিত্যক্ত স্থানকে প্রকৃতির কাছাকাছি ফিরিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই পেতিত সিন্তুর।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ব্যস্ততম এলাকাগুলোর পাশ দিয়ে গেছে এই রেললাইনটি। একসময় এটি শহরের মালপত্র ও যাত্রী পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর প্রয়োজনীয়তা কমে আসে এবং একসময় এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এরপর প্যারিস সিটি কর্পোরেশন এবং এসএনসিএফ রেসো (SNCF Réseau), ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে এই রেললাইনটিকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭ কিলোমিটার রেললাইনকে সবুজ স্থানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ২০২৬ সাল নাগাদ আরও প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
পেতিত সিন্তুরের প্রতিটি অংশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোথাও পথ তৈরি করা হয়েছে, কোথাও বা তৈরি করা হয়েছে বাগান। আবার কিছু অংশে প্রকৃতিকে তার নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়েছে। ১২তম অ্যারোন্ডিসমেন্টের (প্যারিসের প্রশাসনিক অঞ্চল) শান্ত পরিবেশে গাছপালা ও সবুজ ঘেরা পথের পাশে হেঁটে যাওয়া বয়স্ক দম্পতি কিংবা সবজি বাগানে কাজ করা মানুষের ছবি দেখলে মনে হয় যেন শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়েছি।
এই লাইনের কোথাও পুরাতন স্টেশনগুলোতে গড়ে উঠেছে ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। উদাহরণস্বরূপ, “লা গার-লে গোর” নামের একটি ক্লাবে গভীর রাত পর্যন্ত চলে জ্যাজ ও টেকনো গানের আসর। ১৫তম অ্যারোন্ডিসমেন্টের একটি অংশে পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে সুন্দর পথ, যা নিউ ইয়র্কের “হাই লাইন”-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে “ভোয়া ১৫” নামের একটি রেস্টুরেন্ট ও কফি শপে তরুণ পেশাজীবীদের ভিড় দেখা যায়, আবার কেউ কেউ এই পথ ধরে নিয়মিত দৌড়ান। এমনকি এখান থেকে আইফেল টাওয়ারের একটি চমৎকার দৃশ্যও উপভোগ করা যায়।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল শহরে বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা বাড়ানো। এখানকার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে। শীতকালে বাদুড়ের দল আশ্রয় নেয় সুড়ঙ্গে, আর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় খেঁকশিয়াল ও বনবিড়াল। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে গাছপালা ও লতাপাতায় ঢেকে যায় চারপাশ, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
পেতিত সিন্তুরের পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কমিউনিটি প্রকল্প। “লা রিকাইক্লেরি” নামের একটি কেন্দ্রে পুরনো জিনিস মেরামতের পাশাপাশি আবর্জনা পুনর্ব্যবহার করা হয়। এখানে একটি খামারে স্বেচ্ছাসেবকরা মুরগি পালন করেন এবং বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। “লা ফার্ম দু রাইল” নামের আরেকটি খামারে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা কাজ করে এবং সবজি উৎপাদন করে।
ঢাকার মতো জনবহুল শহরগুলোতেও কি এমন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব? নিঃসন্দেহে, পরিত্যক্ত রেললাইন বা অব্যবহৃত স্থানগুলোকে সবুজায়নের মাধ্যমে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে, সেই সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। প্যারিসের পেতিত সিন্তুর আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান