বহু বছর আগের একটি তেল বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনো তাজা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নাইজেরিয়ার উপকূলে বিশাল তেল উৎপাদনকারী জাহাজ ‘বোঙ্গা’ থেকে তেল স্থানান্তরের সময় ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এর কয়েক বছর পর, ফাঁস হওয়া কিছু নথিপত্র এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমীক্ষা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
জানা গেছে, শেল তেল কোম্পানির বহরে থাকা জাহাজগুলোতে এখনো নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে, যা ভবিষ্যতে আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
২০১১ সালের ভয়াবহ ঘটনার পর, সম্প্রতি পাওয়া কিছু গোপন নথিপত্র বলছে, বোঙ্গা সহ শেল-এর তেল উৎপাদনকারী জাহাজগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানা যায়, তেল স্থানান্তরের পদ্ধতি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সরঞ্জামগুলিতে ত্রুটি রয়েছে।
এর ফলে, ভবিষ্যতে বোঙ্গার মত বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে বোঙ্গা থেকে প্রায় ৪০ হাজার ব্যারেল তেল আটলান্টিক মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা ছিল নাইজেরিয়ার ইতিহাসে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় তেল বিপর্যয়ের একটি। এর ফলে বিশাল এলাকা জুড়ে তেলের আস্তরণ তৈরি হয়, যা নিউ ইয়র্ক শহরের দ্বিগুণ আকারের চেয়েও বেশি ছিল।
এই ঘটনার জন্য নাইজেরিয়ার নিয়ন্ত্রক সংস্থা শেল-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান শেল নাইজেরিয়া এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানিকে (SNEPCo) প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করে, যা বাংলাদেশি টাকায় বিশাল একটি অঙ্ক। যদিও কোম্পানিটি এখনো এই জরিমানার বিরুদ্ধে আপিল করছে।
২০২২ সালে শেল-এর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষণে বোঙ্গা সহ বেশ কয়েকটি জাহাজে ত্রুটি ধরা পড়ে। নিরীক্ষণ প্রতিবেদনে মরিচা ধরা থেকে শুরু করে দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ এবং ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়। তেল স্থানান্তরের সময় যে পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলি ছিল, তা ২০১১ সালের দুর্ঘটনার কারণ হয়েছিল এবং ২০২২ সালেও বোঙ্গাতে এই সমস্যাগুলো ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শেয়ারহোল্ডারদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় কর্মীদের নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগের চিত্রও উঠে এসেছে। ২০১২ সাল থেকে, শেল-এর কর্মীদের নিয়ে চালানো জরিপে দেখা গেছে, রক্ষণাবেক্ষণ, যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা সচেতনতার মতো বিষয়গুলোতে কর্মীদের ধারণা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
কর্মীদের মধ্যে দক্ষ জনবলের অভাব এবং যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলোও উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ২০১৪ সালের এক জরিপে, বোঙ্গার কর্মীরা তাঁদের জাহাজের পরিস্থিতিকে ‘বারুদের স্তূপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে, শেল কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্রমাগত উন্নত করছে। তাদের মতে, ২০১৮ সাল থেকে এই ধরনের জাহাজে বড় ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে এবং ছোটখাটো দুর্ঘটনার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
এছাড়া, তারা তাদের জাহাজে থাকা নিরাপত্তা সরঞ্জামের মান উন্নয়নের কথাও জানিয়েছে।
শেল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলের ফ্লুমিনেন্স নামের একটি জাহাজে পাইপ এবং তেলের ট্যাঙ্কের সুরক্ষামূলক কাঠামোতে গুরুতর ক্ষয় দেখা গেছে। এছাড়া, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে একটি জাহাজে দুর্ঘটনায় দুই কর্মী গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে নোঙর করা গ্যাস উৎপাদনকারী জাহাজ ‘প্রেলুড’-এ ২০২১ সালে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। অস্ট্রেলীয় কর্তৃপক্ষও পরবর্তীতে এই জাহাজে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন লঙ্ঘনের প্রমাণ পায় এবং উন্নতির নির্দেশ দেয়।
শেল কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা কর্মীদের নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় সবসময় সচেষ্ট। তবে ফাঁস হওয়া নথি এবং কর্মীদের উদ্বেগে আবারও পুরোনো সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি ফিরে এসেছে, যা কোম্পানিটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস