গ্রিস প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি) ব্যয়ে একটি বিশাল সামরিক পুনর্গঠন কর্মসূচি শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া দেশটি প্রথম। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের কারণে গ্রিস এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই পুনর্গঠন কর্মসূচির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘শিল্ড অফ অ্যাকিলিস’ নামক একটি বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস পার্লামেন্টে জানান, এটি মূলত বিদ্যমান বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন কিছু প্রযুক্তি যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, জাহাজ, সাবমেরিন এবং ড্রোন—এই পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম।
এই কর্মসূচি ‘এজেন্ডা ২০৩০’ নামে পরিচিত বৃহত্তর সামরিক সংস্কার পরিকল্পনার একটি অংশ। প্রধানমন্ত্রী মিতসোতাকিস এই পরিবর্তনকে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় পরিবর্তন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে এবং সশস্ত্র বাহিনী আগে যে ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল, এখন তাদের ভিন্ন ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তুরস্কের সঙ্গে গ্রিসের দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই দেশটি প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর গ্রিস তার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর গড় ব্যয়ের (১.৯ শতাংশ) তুলনায় এটি অনেক বেশি।
ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ন্যাটো জোটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে বিতর্কের মধ্যে, ইইউ সম্প্রতি অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা খাতে ৬৫০ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৭১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার) ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো ২০২৩ সালে প্রতিরক্ষা খাতে ৫৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এছাড়া, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করতে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ১৫0 বিলিয়ন ইউরোর (প্রায় ১৬ হাজার ৩শ কোটি মার্কিন ডলার) স্বল্প সুদের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
গ্রিস এবং পোল্যান্ডের মতো সীমান্ত-সংলগ্ন দেশগুলো এই আর্থিক বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য জোরালো চেষ্টা চালিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মিতসোতাকিস আরও বলেন, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে একটি যৌথ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত, যা সমস্ত দেশকে সুরক্ষা দেবে এবং এর জন্য ইউরোপীয় অনুদান ব্যবহার করা যেতে পারে, ঋণ নয়।
গ্রিসের ধারণা, ব্রাসেলস (ইউরোপীয় কমিশনের সদর দপ্তর) অনেক সদস্য রাষ্ট্রের চেয়ে কম খরচে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। তাই যৌথভাবে ঋণ গ্রহণ করা প্রতিটি দেশের জন্য আলাদাভাবে ঋণ নেওয়ার চেয়ে বেশি লাভজনক হবে।
সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্রিস দীর্ঘদিন ধরেই ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। ২০১৯ সালে দেশটি ফ্রান্সের কাছ থেকে ২.৫ বিলিয়ন ডলারে ১৮টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার ঘোষণা দেয় এবং এক বছর পর এই সংখ্যা ২৪-এ বৃদ্ধি করে। ২০২১ সালে গ্রিস ফ্রান্সের সঙ্গে একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার অধীনে ফ্রান্সের কাছ থেকে ২.২৬ বিলিয়ন ইউরোতে (প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) অত্যাধুনিক তিনটি বেলহাররা ফ্রিগেট (যুদ্ধজাহাজ) কেনার চুক্তি হয়, চতুর্থটি কেনারও সম্ভাবনা রয়েছে।
যুদ্ধবিমান এবং ফ্রিগেটগুলোতে ফরাসি প্রযুক্তির অত্যাধুনিক অস্ত্র ও রাডার স্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অ্যাস্টার-৩০ ক্ষেপণাস্ত্র, যা শব্দের চেয়ে সাড়ে চার গুণ বেশি গতিতে চলতে পারে। এছাড়া রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক মিউ-৯০ টর্পেডো, ২০০ কিলোমিটার পাল্লার (১২৪ মাইল) এক্সোসেট অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র এবং থ্যালেস সি ফায়ার রাডার। রাফায়েল যুদ্ধবিমানেও ফরাসি নির্মিত বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে।
গত বছর গ্রিস যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ২০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার অর্ডার দিয়েছে। এছাড়া, তারা চায় গ্রিক কোম্পানিগুলো যেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রজন্মের কনস্টেলেশন ফ্রিগেট তৈরিতে সহযোগিতা করে।
এ বিষয়ে একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেছেন, গ্রিসকে প্রতিরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, কারণ এটি তাদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই গ্রিসের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা