আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ, ১৯৮০-এর দশকের এক হৃদয়বিদারক ঘটনা, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। সেই সময়, উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেকার গভীর বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিবিসি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অনাহারক্লিষ্ট ইথিওপীয়দের ছবি দেখে সারা বিশ্বের মানুষ যখন তাদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারল, তার অনেক আগে থেকেই কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের কথা জানতেন যুক্তরাজ্যের অনেক কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পী।
মূলত, এই দুর্ভিক্ষের শিকার হওয়া ইথিওপিয়া ছিল অনেক রাস্টাফারিয়ান সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক ভূমি। তাদের অনেকের কাছে প্রাক্তন সম্রাট হাইলে সেলাসি ছিলেন ঈশ্বরের দূতস্বরূপ। তাই, দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া মাত্রই তারা সেখানকার মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্যোগী হন।
এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৮৪ সালে, ‘ব্রিটিশ রেগে আর্টিস্টস ফেমিন অ্যাপিল’ (BRAFA) নামে পরিচিত একদল কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ শিল্পী একত্রিত হয়ে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ গান তৈরি করেন। গানটির নাম ছিল ‘লেটস মেক আফ্রিকা গ্রিন এগেইন’। এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন শিল্পী লিওন লাইফার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডেনিস ব্রাউন, আসওয়াদ, জ্যানেট কেই-এর মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা।
সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো এই BRAFA-র কথা সেভাবে পৌঁছায়নি, কারণ একই সময়ে ব্যান্ড এইড-এর মতো বিশাল জনপ্রিয় একটি আন্তর্জাতিক চ্যারিটি প্রকল্পও চলছিল। তবে, লাইফার মনে করেন, তাঁদের এই উদ্যোগ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “আমরা সবসময় আফ্রিকা নিয়ে গান গেয়েছি। তাই, আমরা চেয়েছিলাম আমাদের কথা কাজে পরিণত করতে।”
গানটি তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রথমে কনসার্টের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে, তাঁরা একটি রেকর্ড তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। রেকর্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর মাধ্যমে ইথিওপিয়ায় পাঠানো হয়।
এই প্রকল্পে লিওন লাইফারের পাশাপাশি ছিলেন আরও অনেক শিল্পী, যেমন—জ্যামাইকান শিল্পী জিন রন্ডো, ড্রামার জাহ বানি, এবং বেসিস্ট এলরয় বেইলি। তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ছিলেন লাইফারের স্ত্রী ফে অ্যাডিসন, এবং তাঁর ব্যান্ডমেট টনি ডগলাস ও কেন ক্যান্ড্রিকস।
রেকর্ডিংয়ের দিন, লাইফার সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, “নিজের অহংকারকে দূরে সরিয়ে সবাই মিলে কাজ করো।” তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে, স্থানীয় আরও ২০০ জনের বেশি মানুষ এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন।
রেকর্ডিংয়ের জন্য স্টুডিও ভাড়া করা কঠিন ছিল, তবে ঘটনাক্রমে তাঁরা গায়ানীয় শিল্পী এডি গ্রান্টের সঙ্গে পরিচিত হন। গ্রান্ট তাঁর নিজস্ব স্টুডিওটি বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য দিতে রাজি হন।
গানটি তৈরি হওয়ার পর, ১৯৮৬ সালের মে মাসে, লন্ডনের শোরডিচ পার্কে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়। কনসার্টে ১০,০০০-এর বেশি মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন এবং প্রায় ৮,০০০ পাউন্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল।
যদিও BRAFA-র এই প্রচেষ্টা সেভাবে প্রচার পায়নি, তবে এর গুরুত্ব আজও অনেক। তাঁদের এই অবদানকে স্বীকৃতি দিতে, ২০২১ সালে শোরডিচ পার্কের একটি অংশের নাম ‘ব্রাফা স্কোয়ার’ রাখা হয়।
আফ্রিকার দুর্ভিক্ষে সাহায্য করার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ শিল্পীদের এই প্রচেষ্টা, সমাজের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যদিও প্রচারের আলোয় আসতে কিছুটা দেরি হয়েছে, তবে তাঁদের কাজ আজও অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা জোগায়।
তথ্যসূত্র: The Guardian