মিয়ানমারে ভূমিকম্প: শতাব্দীর ঐতিহ্য ধূলিসাৎ!

শিরোনাম: মিয়ানমারে ভূমিকম্প: ধ্বংসস্তূপে ঐতিহ্য, শোকের ছায়া

গত ২৮শে মার্চ, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে ৭.৭ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেশটির ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানগুলি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization – WHO) হিসাব অনুযায়ী, ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি এবং আহত হয়েছেন ৪,৫০০ জনের বেশি।

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে এর ফলস্বরূপ চার বছর ধরে চলা সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী গৃহযুদ্ধের মধ্যে মিয়ানমার সরকার তিন সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল সাগাইং এবং ম্যান্ডালে শহরের কাছাকাছি, যা দেশটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি শহরের আশেপাশে থাকা অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির (প্যাগোডা) এবং মসজিদগুলিও ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে।

ধ্বংস হয়ে যাওয়া একশটির বেশি বৌদ্ধ মন্দির এবং প্রায় পঞ্চাশটি মসজিদ দেশটির সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারের মন্দির, মসজিদ, মঠ এবং নানারিগুলি শুধুমাত্র উপাসনালয় নয়, বরং সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই স্থানগুলো প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান, বয়স্কদের যত্ন নেওয়া, এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ও এতিম শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক মিত্রি আং-থুইন জানিয়েছেন, “ধর্মীয় স্থানগুলির ক্ষতি হওয়ায় সেখানকার মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দুর্বলতা আরও বেড়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে মঠ ও নানারিগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন এবং পুণ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন দান করেন।

ডার্টমাউথ ইউনিভার্সিটির মিয়ানমারে বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এম.কে. লং-এর মতে, “বৌদ্ধধর্মে পুণ্য অর্জন এই জীবনে এবং ভবিষ্যৎ জীবনে মানুষের অবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান হলো:

* **শ্বে সার ইয়ান প্যাগোডা:** ম্যান্ডালের ৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই প্যাগোডাটি প্রায় ১০০০ বছরের পুরনো।

ভূমিকম্পের ফলে এর সোনালী চূড়া ভেঙে পড়েছে।

আং-থুইন জানিয়েছেন, এই প্যাগোডা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

এখানে বার্ষিক উৎসবগুলি স্থানীয় কৃষকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

* **সাক্যধিতা নানারি:** ম্যান্ডালের পশ্চিমে অবস্থিত এই নানারি নারীদের ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার জন্য পরিচিত।

১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই নানারিতে প্রায় ২০০ জন ছাত্রী পড়াশোনা করতেন।

লং জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে এখানকার অন্তত তিনটি ভবন ধসে পড়েছে।

এই ঘটনায় ছয়জন সন্ন্যাসিনী এবং তিনজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।

* **মে নু ব্রিক মঠ:** এই মঠটি (মহা আং মিয়ে বোম সান মঠ নামেও পরিচিত) একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান এবং পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল।

এই মঠটি ১৮৩৮ সালের ভূমিকম্পেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

* **নতুন মাসোয়েইন মঠ:** ম্যান্ডালের এই মঠটি সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

এটিতে কয়েকশ সন্ন্যাসীর জন্য খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

ঐতিহাসিক স্থানগুলির পুনরুদ্ধার বেশ কঠিন, কারণ এগুলির নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়নি।

প্রকৌশলী জ্যারেড কিন বলেছেন, “দুর্ভাগ্যবশত, এই ভবনগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ আধুনিক স্টিল ও কংক্রিটের মতো এখানে কাঠামো তৈরি করা হয়নি।

তবে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলির পুনরুদ্ধারকে আরও কঠিন করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিয়ানমার গবেষণা নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী টমাস ওয়েলস বলেছেন, “পুনর্গঠনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো একটি নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অনুসন্ধানী দলের প্রাক্তন সদস্য ক্রিস সিডোট বলেছেন, “যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের পুনর্গঠন সম্ভব নয়।

যদিও যুদ্ধবিরতি কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে, তবে দেশটির দারিদ্র্য, দুর্বল অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই মূল্যবান স্থানগুলির পুনরুদ্ধার একটি জটিল প্রক্রিয়া হতে চলেছে।

তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *