ফিলিস্তিনের এক কিশোর, যিনি ইসরায়েলি কারাগারে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে খাদ্যসংকটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিকিৎসকদের দেওয়া একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কারাগারে থাকাকালীন ওই কিশোর মারাত্মক অপুষ্টির শিকার হয়েছিলেন।
জানা গেছে, ১৭ বছর বয়সী ওয়ালিদ আহমাদ নামের ওই কিশোরকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই ছয় মাস ধরে আটক করে রাখা হয়েছিল। ইসরায়েলি চিকিৎসক ড. ড্যানিয়েল সলোমনের তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্ত করা হয়।
তিনি জানান, আহমাদ চরম অপুষ্টিতে ভুগছিলেন এবং তাঁর শরীরে কোলনে প্রদাহ ও স্ক্যাবিসের মতো চর্মরোগের চিহ্নও ছিল। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ওয়ালিদের পরিবার ড. সলোমনের রিপোর্টটি সংগ্রহ করেছে।
যদিও প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি, তবে এতে বলা হয়েছে, আহমাদ মারাত্মকভাবে ওজন হারিয়েছিলেন এবং তাঁর মাংসপেশি শুকিয়ে গিয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ডিসেম্বর মাস থেকে আহমাদ কারাকর্তৃপক্ষের কাছে পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। কারাগারের মেডিকেল ক্লিনিকের বরাতে জানা যায়, গত মাসে মেগিদো কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন আহমাদ এবং মাথায় আঘাত পান।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্য বন্দীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই ঘটনা জানা গেছে। ইসরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আহমাদ এর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি দল গঠন করা হয়েছে এবং তাদের ফলাফল যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
ফিলিস্তিনের মানবাধিকার সংস্থা ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েল’-এর তথ্য অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি কারাগারে নিহত হওয়া ফিলিস্তিনি বন্দীদের মধ্যে আহমাদ সর্বকনিষ্ঠ। জানা যায়, গত সেপ্টেম্বরে অধিকৃত পশ্চিম তীরে এক ভোরে অভিযান চালিয়ে আহমাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
তাঁর পরিবারের দাবি, সৈন্যদের দিকে পাথর ছোড়ার অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়।
আহমাদের পরিবারের আইনজীবী নাদিয়া দাক্কা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি আদালতের অনুমতি নিয়ে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সার্জন ড. সলোমন ময়নাতদন্ত পর্যবেক্ষণ করেন। ময়নাতদন্ত হয় ইসরায়েলের আবু কবির ফরেনসিক ইনস্টিটিউটে, তবে তারা এখনো তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েলের বন্দীশালাগুলোতে ব্যাপক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ৭ অক্টোবর, ২০২৩-এ হামাসের হামলার পর ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকহারে বন্দী করা হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দাবি, ইসরায়েল তাদের হেফাজতে থাকা ৭২ জন ফিলিস্তিনি বন্দীর মরদেহ এখনো ফেরত দেয়নি।
এর মধ্যে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর।
কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। সেখানকার প্রাক্তন বন্দীদের বরাত দিয়ে জানা যায়, কারাগারে মারধর, অতিরিক্ত ভিড়, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা, স্ক্যাবিস বা চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিদ্যমান।
‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েল’-এর বন্দী ও আটক বিভাগ প্রধান নাজি আব্বাস বলেছেন, মেগিদো কারাগারটি একটি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কেন্দ্র, যেখানে অনেক ফিলিস্তিনি বন্দী, এমনকি কিশোরদেরও বিনা বিচারে রাখা হয়। এটিকে একটি কঠোর কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইসরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছে, তারা আইন মেনেই কাজ করে এবং সকল বন্দীকে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়।
আহমাদের আইনজীবী ফিরাস আল-জাবরিনি জানিয়েছেন, তিনি কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাননি। তবে, কারাগারে আটক তিনজন বন্দী তাঁকে জানিয়েছেন, আহমাদ মৃত্যুর আগে মারাত্মক ডায়রিয়া, বমি, মাথাব্যথা এবং মাথা ঘোরাসহ নানা উপসর্গে ভুগছিলেন।
তাঁদের ধারণা, নোংরা জল এবং রমজান মাসে কারারক্ষীদের আনা বাসি পনির ও দই খাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছিল।
ড. সলোমনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আহমাদ সম্ভবত কোলাইটিস বা বৃহৎ অন্ত্রের প্রদাহে ভুগছিলেন, যার কারণে ঘন ঘন ডায়রিয়া হতে পারে এবং এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত অল্পবয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে কোলাইটিস মৃত্যুর কারণ হয় না। সম্ভবত মারাত্মক অপুষ্টির কারণে এটি আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছিল।
ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েলের বোর্ড প্রধান ড. লিনা কাসেম হাসান এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “ক্ষুধার কারণে আহমাদ মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। এর সঙ্গে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে তাঁর ডিহাইড্রেশন হয় এবং শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এই কারণে হৃদস্পন্দনে সমস্যা হয়ে তাঁর মৃত্যু হতে পারে।
ড. লিনা কাসেম আরও বলেন, এই ঘটনায় চিকিৎসা অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট। অপুষ্টির কারণে আহমাদ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ড. আর্নে স্ট্রাই-পেডারসেন জানান, “প্রতিবেদন দেখে মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টি ও অসুস্থতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আমার ধারণা, মৃত্যুর মূল কারণ ছিল শরীর শুকিয়ে যাওয়া।
প্রতিবেদনে তাঁর পায়ে ও যৌনাঙ্গে স্ক্যাবিসের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ফুসফুসের মাঝে বাতাস জমে তাঁর ঘাড় ও পিঠেও ছড়িয়ে পড়েছিল, যা সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
আহমাদের পরিবার জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের আগে তিনি একজন সুস্থ ও খেলাধুলাপ্রিয় কিশোর ছিলেন। তাঁর বাবা খালিদ আহমাদ জানান, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁর ছেলের চারটি সংক্ষিপ্ত শুনানিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে তিনি তাঁর ছেলের দুর্বল স্বাস্থ্য দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন।
আহমাদের পরিবার এখনো ইসরায়েলের কাছ থেকে মৃত্যুর সনদ পায়নি। তাঁরা ড. সলোমনের রিপোর্টের মাধ্যমে ছেলের মরদেহ ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
আহমাদের বাবা বলেন, “আমরা আমাদের ছেলের মরদেহ দাফনের জন্য ফেরত চাই। ইসরায়েলি কারাগারে যা ঘটছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। এখানে জীবনের কোনো মূল্য নেই।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস