ট্রাম্পের আমলে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ দমনের ছায়া: অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নতুন উদ্যম?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো একদিকে যেমন মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তেমনই এর প্রতিক্রিয়ায় অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নতুন করে জেগে উঠছেন অনেকে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। ঐতিহ্যগতভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিবাদ ও ভিন্নমতের জন্য পরিচিত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নতুন নীতিমালার কারণে সেখানকার পরিবেশ এখন অনেকটাই বদলে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের ফলে ক্যাম্পাসে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হলো নিরাপত্তা জোরদার করা।
গত কয়েক মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কয়েকশ’ বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ স্থগিত করা এবং ক্যাম্পাসগুলোতে নীতিগত পরিবর্তন আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, এর মূল উদ্দেশ্য হলো, ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে সমালোচকদের মতে, এর ফলে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরেছে। এখন এই ইস্যুতে বিতর্ক রাজনৈতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, কর্তৃপক্ষের দমননীতি রুখতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হতে পারে।
ইতিমধ্যেই, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়কে ২১০ মিলিয়ন ডলার এবং ব্রাউন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাক্রমে ৫১০ মিলিয়ন ও ৯ বিলিয়ন ডলারের তহবিল পর্যালোচনা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, গত বছর থেকে ইহুদিবিদ্বেষের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং তাদের ‘বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ (Diversity, Equity, and Inclusion – DEI) কর্মসূচিগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অধ্যাপক কিম লেন শেপেলের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত কলম্বিয়াকে নিশানা বানিয়ে শুরু করলেও, তারা মনে করেন না যে শুধু কলম্বিয়াই এই নিষেধাজ্ঞার শিকার হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
কর্তৃপক্ষের নতুন নীতিমালার কারণে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীদের মুখ ঢাকা, এমনকি একাডেমিক ভবনের আশেপাশেও মিছিল করার অনুমতি নেই। এছাড়া, বিক্ষোভ দমনের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নতুন পুলিশও নিয়োগ করা হয়েছে।
তবে কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপে অনেকের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে মনে করছেন, এখন ক্যাম্পাস একটি দুর্গে পরিণত হয়েছে। ক্লাসে যেতেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন।
অন্যদিকে, এই পরিস্থিতিতে কিছু শিক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, কর্তৃপক্ষের এই সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠরোধ করতে পারবে না। বরং এর ফলে প্রতিবাদ আরও বাড়তে পারে, যা হয়তো আরও গোপন এবং তীব্র রূপ নেবে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সব সময়ই টিকে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (UC Berkeley) মুক্তভাবে কথা বলার দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা আজও স্মরণীয়।
বর্তমানে, শিক্ষক ও কর্মচারী ইউনিয়নগুলো কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তারা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথেও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলো শিক্ষা বিভাগের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা খর্ব করার নজিরবিহীন প্রচেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
হার্ভার্ড ল স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মতে, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তিনি মনে করেন, অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করা উচিত।
শেপেলের মতে, সমাজের বৃহত্তর অংশের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি যে, গণতন্ত্রের জন্য তাদের কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীল ফ্লিগস্টাইন মনে করেন, শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাব রয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি ট্রাম্প প্রশাসন একটি একটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আঘাত হানে, তাহলে তাদের প্রধানরা হয়তো নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।
সব মিলিয়ে, অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নতুন করে জেগে ওঠা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একদিকে যেমন বাস্তবতার ছাপ, তেমনি ভবিষ্যতের প্রতি তারা দারুণভাবে আশাবাদী। তাদের মতে, দেশের মৌলিক অধিকার ও মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্ব এখন তাদের নিজেদেরই।
তথ্য সূত্র: CNN