মানুষ আসলে গল্প বলতে ভালোবাসে। মানুষের মস্তিষ্ক সেইভাবেই তৈরি হয়েছে।
আমরা সবাই যেন এক একটা গল্পের চরিত্র, আর আমাদের চারপাশের জগতটা একটা বিশাল গল্পের মঞ্চ। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে, লেখক উইল স্টোর এই ধারণাটি তুলে ধরেছেন, যা আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের জীবনকে নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
উইল স্টোরের মতে, মানুষ হিসেবে আমাদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো গল্প বলার ক্ষমতা। অন্যান্য প্রাণীর মতো, আমরাও টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করি – খাদ্য, নিরাপত্তা এবং প্রজনন আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
কিন্তু মানুষের একটি বিশেষত্ব আছে: আমরা একটি ‘গল্পের জগতে’ বাস করি, যা আমাদের কল্পনার জগৎ থেকে তৈরি। আমাদের মস্তিষ্ক এই বাস্তবতাকে নানাভাবে সাজিয়ে গল্প তৈরি করতে চায়।
আমরা নিজেদের জীবনের নায়ক হিসেবে দেখি, যেখানে বন্ধু এবং শত্রু থাকবে, এবং আমরা একটি সুন্দর সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের ভেতরে থাকা কণ্ঠস্বর সবসময় আমাদের আত্মজীবনী রচনা করে চলেছে।
এই গল্পের জগৎটাই আমাদের মনোবৈজ্ঞানিক সময় কাটানোর আসল জায়গা। এখানে, আমাদের ‘পরিচয়’ তৈরি হয় – আমরা কে, সেই ধারণাগুলো নিয়েই আমাদের পরিচয় গঠিত হয়।
আমাদের এই পরিচয়ের প্রতি আকর্ষণ এতটাই বেশি যে, অনেক সময় জীবনের চেয়েও তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষী আছে, মানুষ তার আদর্শ, দেশ, বা বিপ্লবের জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করে না।
আমাদের পরিচিত জগৎ-এ, আমরা দুটি জিনিস সবচেয়ে বেশি খুঁজি: অন্যদের সঙ্গে সংযোগ এবং সামাজিক মর্যাদা। সবাই ভালোবাসা পেতে চায়, সম্মান পেতে চায়, এবং এগুলো হারাতে ভয় পায়।
টিকে থাকা, সম্পর্ক তৈরি করা, এবং সামাজিক অবস্থান – এই বিষয়গুলো প্রায় সব গল্পের মূল বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘এলিয়েন’ (Alien) বা ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ (The Revenant) -এর মতো সিনেমাগুলো টিকে থাকার গল্প বলে, ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’ (Brokeback Mountain) বা ‘স্ট্যান্ড বাই মি’ (Stand By Me) সম্পর্কের কথা বলে, আর ‘হুইপ্ল্যাশ’ (Whiplash) বা ‘বার্বি’ (Barbie) সামাজিক মর্যাদার প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
আর ‘স্টার ওয়ার্স’ (Star Wars), ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, বা ‘গডফাদার’-এর মতো গল্পগুলো এই তিনটি বিষয়কেই একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলে।
নিজের ‘গল্পের চরিত্র’ এবং ‘গল্পের জগৎ’-এর এই ধারণা আমাকে জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলো বুঝতে সাহায্য করেছে। যখন উদ্বেগ বা হতাশা আসে, তখন আমি বুঝতে পারি, এর কারণ কি আমার শারীরিক অসুস্থতা? নাকি প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকা বা তাদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া?
অথবা হয়তো আমার সামাজিক অবস্থান নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে? আমার কাজ কেমন চলছে, সামাজিক মাধ্যমে কোনো বিদ্রূপাত্মক আলোচনা চলছে কিনা, বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কে ভালো করছে, সেই বিষয়গুলোও আমাকে প্রভাবিত করে। উইল স্টোর মনে করেন, এই বিষয়গুলোর যেকোনো একটি অথবা দুটির কারণে আমাদের মানসিক চাপ বাড়ে।
এই ‘পরিচয় সংকট’-এর ধারণাটি আমাকে সাহায্য করেছে। যারা আত্মহত্যা করতে চান, তাদের অনেকের ব্যক্তিগত সংকট থাকে, যা সম্পর্ক বা সামাজিক মর্যাদার অভাব থেকে তৈরি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে, সহানুভূতিপূর্ণ কিছু কথা তাদের মানসিক শান্তির জন্য খুব দরকারি।
আসলে, আমরা নিজেরাই একে অপরের প্রতি ‘পরিচয় সংকট’ তৈরি করি। সমাজের চোখে ভালো মানুষ হিসেবে টিকে থাকতে হলে, আমাদের কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়।
যারা সেই নিয়ম ভাঙেন, তাদের সামাজিক স্বীকৃতি কমে যায়। বিদ্যালয়ে ভালো বন্ধু তৈরি করতে আমারও সমস্যা হয়েছে, হয়তো আমার ব্যক্তিত্বের কারণেই।
তবে এখন আমি বুঝি, এই ‘গল্পের জগৎ’-এর নিষ্ঠুরতাই আমাকে সেই কষ্টের জন্ম দেয়।
রাজনৈতিক বিভাজন ও ঘৃণা বর্তমানে একটি উদ্বেগের বিষয়। উইল স্টোরের গবেষণা আমাদের বিভিন্ন দলের মধ্যেকার বিদ্বেষ বুঝতে সাহায্য করে।
মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মূল কারণ হলো গল্প। গল্প বলার মাধ্যমেই আমরা দলবদ্ধভাবে কাজ করতে শিখেছি। আমাদের মস্তিষ্ক সত্যের চেয়ে গল্পের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।
আমরা সিনেমা হলে যাই, নিজেদের ভুলে যাই, এবং সিনেমার চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। এই ঘটনার মাধ্যমে গল্প আমাদের মনে প্রভাব ফেলে। এমনকি যারা আমাদের প্রতিপক্ষ, তারাও তাদের নিজস্ব গল্পে বিশ্বাসী।
উইল স্টোরের মতে, যারা আমাদের চোখে খারাপ, তারাও হয়তো তাদের নিজস্ব গল্প অনুযায়ী সঠিক কাজটাই করছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, তারাও এই ‘গল্পের জগৎ’-এরই একটা চরিত্র।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান