ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে বসবাসকারী বেদুইন সম্প্রদায়ের উপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। তাদের অভিযোগ, জোরপূর্বক তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে।
আল জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৭ই অক্টোবর, ২০২৩ থেকে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা শুরুর পর থেকেই এই অঞ্চলে বসবাসকারী বেদুইনদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী যাযাবর সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত এই বেদুইনদের উপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়ন চালিয়ে আসছে।
পশ্চিম তীরের একটি গ্রাম, য্যানুতা (Zanuta)-র বাসিন্দা ৪5 বছর বয়সী ফায়েজ আটিল জানান, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই তাদের গ্রামে হামলা করে এবং তাদের সম্পত্তি ও গাড়িতে ভাঙচুর চালায়।
এমনকি তাদের ভেড়া চুরি করারও চেষ্টা করে। তিনি আরও বলেন, “মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমাগত হামলা ও হুমকির কারণে য্যানুতার প্রায় ২৫০ জন বাসিন্দা ধীরে ধীরে তাদের গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আটিল জানান, অক্টোবর মাসের শেষে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা এক বৃদ্ধ রাখালকে মারধর করার পর তিনি তার পরিবার নিয়ে গ্রাম ছাড়েন।
ফিলিস্তিনের মানবাধিকার সংস্থা আল-হকের তথ্যমতে, ৭ই অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা বাস্তুচ্যুত হওয়া বেদুইন সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৪৬।
ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থা বি’সেলেমের মুখপাত্র শাই পার্নেস বলেন, “বেদুইন সম্প্রদায়ের উপর যা ঘটছে, তা শুধু কিছু সহিংস ও উগ্র বসতি স্থাপনকারীর কাজ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
পার্নেস আরও যোগ করেন, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পরে, সরকার হাজার হাজার রিজার্ভ সেনা সদস্যকে পশ্চিম তীর থেকে সরিয়ে গাজায় পাঠায় এবং তাদের জায়গায় চরমপন্থী বসতি স্থাপনকারীদের নিয়োগ করে। এই বসতি স্থাপনকারীরা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক পোশাক পরে ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা চালাচ্ছে এবং তাদের গ্রেপ্তারও করছে।
পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকা ‘এলাকা সি’ (Area C)-এর অন্তর্ভুক্ত, যা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এখানে বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি যাযাবর সম্প্রদায়ের মানুষদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে প্রায়ই সেনা সহায়তা পায়। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির মাধ্যমে এই তিনটি অঞ্চলের সৃষ্টি হয়।
ফিলিস্তিনি মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলোর মতে, এমনকি ইসরায়েলের নাগরিকত্ব পাওয়া বেদুইনদেরও তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে।
নাকাব মরুভূমিতে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি ‘অনুমোদনহীন গ্রামে’ বসবাস করে। এরা মূলত সেই ফিলিস্তিনিদের বংশধর, যারা ১৯৪৮ সালে ‘নাকবা’র সময় নিজেদের ভূমিতে টিকে ছিলেন।
ইসরায়েল সরকার এই ‘অনুমোদনহীন গ্রাম’-এর বাসিন্দাদের শহরগুলোতে পুনর্বাসন করতে চায়। তবে এতে তাদের ঐতিহ্যপূর্ণ জীবনযাত্রা, বিশেষ করে পশুপালন, হুমকির মুখে পড়বে।
খান আল-সিরা গ্রামের বেদুইন নেতা খলিল আলামুর জানান, “আমরা আমাদের ভূমির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আমরা চাইলেই অন্য কোথাও চলে যেতে পারি না।
আলামুর আরও জানান, ইসরায়েল সরকার ‘অনুমোদনহীন গ্রাম’-গুলোতে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না এবং বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি কেড়ে নেয়।
নভেম্বর, ২০২৩-এ ইসরায়েলি পুলিশ উম্ম আল-হিরান গ্রামটি ভেঙে দেয়। অথচ সেখানকার বেদুইন বাসিন্দারা ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতে রাজি ছিলেন।
ওয়াদি আল-সিক-এর প্রধান আবু বাশার জানান, তার সম্প্রদায়কে ইসরায়েলের জন্মের পর থেকে চারবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে।
৭ই অক্টোবরের কয়েকদিন পর বসতি স্থাপনকারীরা তাদের গ্রামে হামলা চালায় এবং বাসিন্দাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। এতে প্রায় ১৮৭ জন – যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি পরিবার ছিল – পায়ে হেঁটে রামোন গ্রামে আশ্রয় নেয়, যেখানে তারা এখনো বসবাস করছে।
ওয়াদি আল-সিক এবং য্যানুতার বাসিন্দারা ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, ইসরায়েলি আদালতের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অধিকার লঙ্ঘনের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। য্যানুতার আইনজীবী কমার মাশরাকি জানান, তিনি ইতোমধ্যে দুটি মামলায় জয়লাভ করেছেন।
জানুয়ারী, ২০২৪-এ য্যানুতা এবং উম্ম ধারিতের বাসিন্দাদের তাদের জমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে অভিযোগ, বসতি স্থাপনকারীরা তাদের গ্রামে ফিরতে চাওয়া পরিবারগুলোর উপর হামলা করে, যার ফলে অনেকে আবারও পালাতে বাধ্য হন।
আটিল জানান, আদালতের নির্দেশে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিতে রাজি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পরিবারগুলো কিছুটা নিরাপদে তাদের গ্রামে ফেরার চেষ্টা করছে।
ওয়াদি আল-সিক-এর আবু বাশার জানান, তার সম্প্রদায় এখনও সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি তারা তাদের জমিতে ফিরেও যান, তবে বসতি স্থাপনকারীরা আবারও তাদের উপর হামলা করতে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা