মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থী বক্তব্য প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের ওপর চাপ বাড়ছে, শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা।
যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র সাংবাদিকদের মধ্যে এখন চরম উদ্বেগ বিরাজ করছে। ফিলিস্তিনপন্থী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খবর প্রকাশের কারণে তাদের ওপর নেমে আসছে নানা ধরনের চাপ। এমনকি, নিজেদের লেখা প্রত্যাহার করতেও বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য প্রতিশোধের ভয়ে এমনটা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি রুমেসা ওজতুর্ক নামের এক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল এবং তাকে আটক করার সিদ্ধান্তের পরই এই উদ্বেগের সূচনা হয়। রুমেসা একটি ছাত্র পত্রিকায় ইসরায়েল বিরোধী একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। এরপরই মূলত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে লেখার মাধ্যমে মতপ্রকাশকেও নির্বাসনযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদকরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে রয়েছেন। তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সরানোর জন্য চাপ আসছে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও তাদের লেখা সরিয়ে ফেলতে চাইছেন। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ‘কলম্বিয়া পলিটিক্যাল রিভিউ’-এর সম্পাদক অ্যাডাম কিন্ডার জানিয়েছেন, তাদের প্রকাশনা সংস্থাটিকে ডজনের বেশি নিবন্ধ সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। এছাড়া, আরও অনেক নিবন্ধের প্রকাশনাও স্থগিত করতে হয়েছে। কিন্ডার বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সঙ্গে যারা একমত নন, তারা প্রতিশোধের ভয়ে আছেন।”
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ‘দ্য স্ট্যানফোর্ড ডেইলি’র সম্পাদক গ্রেটা রেইখ জানিয়েছেন, তাদের পত্রিকায়ও লেখা সরানোর জন্য অনুরোধ বাড়ছে। তিনি বলেন, “প্রথমে একজন, তারপর দুইজন, এরপর পাঁচজন এবং সবশেষে ১০ জনের বেশি অনুরোধ এসেছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র থেকে শুরু করে, যারা মতামত বিভাগে লিখতেন, তাদের নাম সরানোর আবেদনও এসেছে। এমনকি, ছবি থেকে তাদের শনাক্ত করার বিষয়টিও এড়াতে বলা হয়েছে। গ্রেটা রেইখ আরও জানান, একজন বিদেশি শিক্ষার্থী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, কারণ তিনি কোনো প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাননি, যা তার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ভয় থেকে মুক্তি পেতে এরই মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক পদত্যাগ করেছেন এবং আরও কয়েকজন ছুটিতে গিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে, ছাত্র সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংগঠন তাদের কর্মীদের পুরোনো নিয়মকানুন পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।
একজন সম্পাদক বলেছেন, “আজ আমরা যা বলছি, তা সাংবাদিকতা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অনেকের ধারণার বিপরীত। তবে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক নয়।”
সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী, কোনো খবর প্রকাশ করার পর তা সরিয়ে ফেলা একটি জটিল বিষয়। একদিকে যেমন সাংবাদিকদের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হয়, তেমনি কর্মীদের নিরাপত্তা ও উদ্বেগের বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হয়। অনেক পত্রিকায় বিতর্কিত নিবন্ধগুলো সার্চ রেজাল্ট থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো বিকল্প পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে, যাতে ওয়েবসাইটে সেগুলো বিদ্যমান থাকে।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্যাভালিয়ার ডেইলি’ সাধারণত লেখা সরানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে থাকে। তবে, তাদের সম্পাদক নাইমা সাওয়ায়া স্বীকার করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি জানান, “আমাদের এক কর্মী, যিনি অভিবাসী ছিলেন, তাকে সম্পাদকীয় বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কারণ, আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক নীতি এবং ফিলিস্তিনপন্থীদের নিয়ে কিছু খবর প্রকাশ করেছিলাম।”
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘ওয়াশিংটন স্কয়ার নিউজ’-এর সম্পাদক ইয়েযেন সাআদাহ জানান, তারা বেনামি নিবন্ধ প্রকাশ করেন না। তবে, যারা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের জন্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটির একজন সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, অভিবাসী শিক্ষার্থীদের আটকের পর তাদের এখানে বেনামি লেখার অনুরোধ বেড়েছে। তিনি বলেন, “বেশিরভাগ অনুরোধ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আসে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।”
গত ফেব্রুয়ারিতে, পারডু ইউনিভার্সিটির একটি ছাত্র পত্রিকা, ‘দ্য পারডু এক্সপোনেন্ট’, তাদের ওয়েবসাইট থেকে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে কথা বলা প্রতিবাদকারীদের নাম এবং ছবি সরিয়ে ফেলেছিল। পত্রিকার সম্পাদক একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তাই আমরা তাদের নাম সরিয়ে দিচ্ছি।” এর পরেই, তারা সাংবাদিকতার নৈতিকতা নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পত্রিকার সম্পাদককে সাত হাজারের বেশি ই-মেইল পাঠানো হয়, যার মধ্যে ছিল হত্যার হুমকিও।
ছাত্র প্রেস আইন কেন্দ্রের আইনজীবী মাইক হিয়েস্টান্ড বলেন, ছাত্র মিডিয়া সাধারণত লেখা সরানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।
বর্তমানে, সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তথ্য সূত্র: The Guardian