শিরোনাম: ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের মোকাবিলায় নতুন দিশা: পানিতে মিশে যাওয়া প্লাস্টিকের আবরণ
বিশ্বজুড়ে ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ই-বর্জ্যের (e-waste) পরিমাণও। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে ৬ কোটি ২০ লক্ষ টনের বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পরিবেশের জন্য এক বিরাট উদ্বেগের কারণ। কারণ, এর মধ্যে এমন কিছু ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক।
বাংলাদেশেও ই-বর্জ্য একটি গুরুতর সমস্যা। পুরোনো মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশনসহ নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী যখন অকেজো হয়ে যায়, তখন তা ডাস্টবিনে বা খোলা জায়গায় ফেলা হয়। এর ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষিত হয়, তেমনই মূল্যবান সম্পদগুলোও পুনর্ব্যবহারের বাইরে চলে যায়।
এই সমস্যার সমাধানে নতুন এক উদ্ভাবন হলো ‘অ্যাকুয়াফেড’ (Aquafade)। এটি এমন এক ধরনের বিশেষ প্লাস্টিকের আবরণ, যা পানিতে ফেললে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে মিশে যায়। এই আবিষ্কারটি ইলেক্ট্রনিক পণ্য পুনর্ব্যবহারের ধারণাটিকে আরও সহজ করে তুলবে।
অ্যাকুয়াফেডের উদ্ভাবক স্যামুয়েল ওয়াংসাপুত্রা (Samuel Wangsaputra)। তাঁর মতে, এই প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হলো, ইলেক্ট্রনিক পণ্য খোলার (disassembly) কঠিন কাজটি বাড়িতেই করা যাবে। ওয়াংসাপুত্রা জানান, তাঁর এই উদ্ভাবনের মূল ধারণা আসে ডিশওয়াশার পড থেকে। এই পডের বাইরের পানিতে দ্রবণীয় স্বচ্ছ ফিল্ম দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং এই ধরনের উপাদান তৈরির কথা ভাবেন। পরবর্তীতে, তিনি ও তাঁর সহ-উদ্ভাবক জুন সাং লি (Joon Sang Lee) মিলে যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানী এনরিকো ম্যানফ্রেডি-হায়লক (Enrico Manfredi-Haylock) এবং মেরিয়াম লামারির (Meryem Lamari) সঙ্গে কাজ করেন।
তাঁরা ‘পিভিওএইচ’ (PVOH) নামক একটি উপাদান খুঁজে পান, যা আঠা তৈরির কাজে লাগে এবং খাদ্যদ্রব্যের মোড়ক হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি নর্দমায় (sewage system) সহজে মিশে যায়। অ্যাকুয়াফেড তৈরি করতে এই উপাদানটি ব্যবহার করা হয়েছে।
অ্যাকুয়াফেডের জলরোধী (waterproof) আবরণ তৈরি করা হয়েছে, যা স্বল্প সময়ের জন্য পানি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। তবে, একবার স্ক্রু খুললেই এটি পানিতে মিশে যাওয়া শুরু করবে। সাধারণত, কোনো ইলেক্ট্রনিক পণ্য পানিতে রাখলে ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে এর আবরণ সম্পূর্ণভাবে মিশে যাবে। ফলে পণ্যের ভেতরের মূল্যবান অংশগুলো আলাদা করা সহজ হবে। এই দ্রবণটি সাধারণ পানির মতোই নর্দমায় মিশে যাবে।
প্রাথমিকভাবে, কনসার্টে ব্যবহৃত এলইডি (LED) রিস্টব্যান্ডের আবরণে অ্যাকুয়াফেড ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর পরে, মিনি পিসি’র (mini PC) ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হবে। ওয়াংসাপুত্রা আরও জানান, ইলেক্ট্রনিক পণ্যের বাইরেও অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন—ল্যাপটপের কভার, গাড়ির ইন্টেরিয়র, ঘড়ি বা সানগ্লাস—এসব ক্ষেত্রেও অ্যাকুয়াফেড ব্যবহার করা যেতে পারে।
যদিও অ্যাকুয়াফেডের উৎপাদন খরচ সাধারণ প্লাস্টিকের থেকে বেশি, তবে নির্মাতারা মনে করেন, ব্যাপক উৎপাদনের ফলে এর দাম কমে আসবে।
তবে, এই প্রযুক্তি নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের মধ্যে উদ্বেগও রয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার এডওয়ার্ডস (Peter Edwards) প্রশ্ন তুলেছেন, পানিতে মিশে যাওয়ার পর এই প্লাস্টিক পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল শেভার (Michael Shaver) বলেছেন, এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অ্যাকুয়াফেডের মতো উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এর সফল প্রয়োগ একদিকে যেমন পরিবেশের জন্য উপকারী হবে, তেমনই পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের উন্নতিতেও সহায়তা করবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন