মস্তিষ্কের কুয়াশা আসলে কী? বিজ্ঞানীরা যা খুঁজে বের করছেন!

নতুন গবেষণা জানাচ্ছে: ‘ব্রেন ফগ’ কী এবং কেন বাড়ছে?

কোভিড-১৯ (COVID-19) সংক্রমণের পর অনেকের মাঝেই দেখা যাচ্ছে মনোযোগের অভাব, স্মৃতি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং মানসিক অবসাদ। অনেক সময় তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতেও হিমশিম খাচ্ছেন।

চিকিৎসকেরা এই উপসর্গকে ‘ব্রেন ফগ’ বা ‘মানসিক অস্পষ্টতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কোভিড পরবর্তী জটিলতা (Long COVID)-এর শিকার হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০ থেকে ৬৫ শতাংশের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

তবে, ‘ব্রেন ফগ’ শব্দটি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি পরিচিত ছিল।

ফাইব্রোমায়ালজিয়া, মায়ালজিক এনসেফালোমাইয়েলাইটিস/দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিন্ড্রোম (chronic fatigue syndrome), এবং লুপাসের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও ‘ব্রেন ফগ’-এর সমস্যা দেখা যায়। এছাড়াও, কেমোথেরাপি এবং কিছু ঔষধ সেবনের কারণেও অনেকের মধ্যে এই সমস্যা হতে পারে।

বিষণ্ণতা (depression) ও সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর সঙ্গেও এর যোগসূত্র রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ব্রেন ফগ’-এর কারণে মনোযোগে সমস্যা, স্মৃতি দুর্বল হওয়া, বিভ্রান্তি এবং মানসিক গতি কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এটি দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় ভোগা রোগীদের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে।

অনেক ক্ষেত্রে, এর সঠিক কারণ খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা কিছু গবেষণার মাধ্যমে এর কারণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন।

আসলে, ‘ব্রেন ফগ’ কোনো নির্দিষ্ট রোগ নয়, বরং এটি অন্তর্নিহিত অন্য কোনো সমস্যার উপসর্গ। বিভিন্ন অবস্থার কারণে কেন একই ধরনের উপসর্গ দেখা যায়, তার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘ব্রেন ফগ’-এর কারণে মনোযোগ, একাগ্রতা অথবা কাজ করার ক্ষমতার মতো বিষয়গুলোতে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ব্রেন ফগ’-কে স্মৃতি বা মনোযোগের দুর্বলতার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় না, যা পরিমাপ করা সম্ভব। অনেক সময়, ‘ব্রেন ফগ’-এর শিকার হওয়া রোগীদের পরীক্ষায় তেমন কোনো সমস্যা ধরা পড়ে না।

এমন পরিস্থিতিতে রোগীরা হতাশ হয়ে পড়েন। এমনকি অনেক চিকিৎসক এটিকে মানসিক সমস্যা হিসেবেও দেখেন। বিশেষ করে, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত বা কোভিড পরবর্তী জটিলতায় ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি হয়।

তবে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসার প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক গবেষণায় ‘ব্রেন ফগ’ এবং প্রদাহের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড-১৯-এর কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে।

এর ফলে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা মস্তিষ্কের কোষসহ শরীরের সুস্থ টিস্যুকে আক্রমণ করে।

কোভিড-১৯-এর কারণে মস্তিষ্কের ধূসর এবং শ্বেত পদার্থের আকারও হ্রাস পেতে পারে, যার ফলে জ্ঞানীয় দুর্বলতা দেখা দেয়।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক পিটার ডেনো বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, মস্তিষ্কের মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে, তা ক্রমাগত প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

এছাড়া, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিন্ড্রোম, পোস্ট অর্থোস্ট্যাটিক টাকাইকার্ডিয়া সিন্ড্রোম এবং কেমোথেরাপির কারণে হওয়া ‘ব্রেন ফগ’-এর ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রদাহ দেখা যায়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ব্রেন ফগ’-এর সঙ্গে মস্তিষ্কের রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা (blood-brain barrier)-র দুর্বলতার সম্পর্ক রয়েছে।

রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা হলো মস্তিষ্কের বাইরের একটি স্তর, যা ক্ষতিকর পদার্থ থেকে মস্তিষ্ককে রক্ষা করে। এই বাধা দুর্বল হয়ে গেলে, ক্ষতিকর পদার্থ মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে এবং নিউরোইনফ্লামেশন বা স্নায়ু প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।

তবে, কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, এই গবেষণাটি ছোট আকারের হওয়ায় বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

গবেষকরা বলছেন, হরমোনের পরিবর্তনের কারণেও ‘ব্রেন ফগ’ হতে পারে। মেনোপজের সময় শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে গেলে মস্তিষ্কের কিছু অংশের আকার হ্রাস পেতে পারে।

থাইরয়েড হরমোনের অভাবেও মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস (hippocampus)-এর আকার ছোট হয়ে যেতে পারে। ট্রমা বা মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে হওয়া ‘ব্রেন ফগ’-এর সঙ্গে গ্রোথ হরমোনের (growth hormone) সম্পর্ক থাকতে পারে।

কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের (gut microbiome) পরিবর্তনের কারণেও ‘ব্রেন ফগ’ হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল রোগে আক্রান্ত, তাদের অর্ধেকের বেশি মানুষের মধ্যে ‘ব্রেন ফগ’-এর লক্ষণ দেখা গেছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেও ‘ব্রেন ফগ’-এর সঙ্গে লড়াই করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

এছাড়া, যারা দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র ‘ব্রেন ফগ’-এর সমস্যায় ভুগছেন, তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঘুমের সমস্যা, ভিটামিন বি-এর অভাব, হরমোনের সমস্যা এবং থাইরয়েডের মতো বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে।

প্রয়োজনে, জ্ঞানীয় পুনর্বাসন থেরাপি (cognitive rehabilitation therapy) নেওয়া যেতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসকেরা মনোযোগ ঘাটতি জনিত সমস্যা (attention deficit disorder) বা এডিএইচডি-এর (ADHD) ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। অ্যান্টিহিস্টামিন এবং অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ব্রেন ফগ’ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে গবেষণা প্রয়োজন।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *