শিরোনাম: বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে আনলেন ১৩ হাজার বছর আগের ডায়ার উলফ: নতুন দিগন্ত নাকি বিতর্ক?
প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক প্রজাতির নেকড়ে, যা ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজেও দেখা গেছে, তাকে আবারও ফিরিয়ে এনেছে বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি, ডালাস-ভিত্তিক একটি বায়োটেক কোম্পানি, কলোসাল বায়োসায়েন্সেস, প্রাচীন ডিএনএ, ক্লোনিং এবং জিন-এডিটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করেছে বলে দাবি করেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তারা সফলভাবে ডায়ার উলফের (Aenocyon dirus) পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন এবং এটি বিশ্বে প্রথম ডি-এক্সটিঙ্কশন (de-extinction) বা বিলুপ্ত প্রজাতি পুনরুদ্ধারের সফল উদাহরণ।
কোম্পানিটি তাদের গবেষণায় ধূসর নেকড়ের (gray wolf) জিন পরিবর্তন করে তিনটি ডায়ার উলফ শাবক তৈরি করেছে। মূলত, এটি একটি সংকর প্রজাতি, যা দেখতে তার বিলুপ্ত পূর্বপুরুষদের মতোই।
ডায়ার উলফ ছিল উত্তর আমেরিকার এক সময়ের শক্তিশালী শিকারি প্রাণী। ধূসর নেকড়ের তুলনায় এরা আকারে বড় ছিল, এদের মাথা সামান্য চওড়া, লোম ছিল ঘন এবং চোয়াল ছিল শক্তিশালী।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রকল্পে কাজ করছে। তারা ২০১৯ সাল থেকে ম্যামথ, ডোডো পাখি এবং তাসমানিয়ান বাঘের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
এই সাফল্যের ফলে, তাদের অন্যান্য প্রকল্পগুলোও দ্রুত এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কলোসালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেন ল্যাম এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই বিশাল মাইলফলক প্রমাণ করে যে আমাদের ডি-এক্সটিঙ্কশন প্রযুক্তি কাজ করে।”
তিনি আরও জানান, তারা ১৩,০০০ বছর আগের একটি দাঁত এবং ৭২,০০০ বছর আগের একটি খুলি থেকে ডিএনএ নিয়ে সুস্থ ডায়ার উলফ শাবক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমানে, তিনটি ডায়ার উলফ শাবককে একটি গোপন স্থানে, প্রায় ২,০০০ একর জায়গার উপর নির্মিত একটি সুরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে। সেখানে ১০ ফুট উঁচু বেড়া, নিরাপত্তা কর্মী, ড্রোন এবং লাইভ ক্যামেরা ফিডের মাধ্যমে তাদের উপর নিয়মিত নজর রাখা হচ্ছে।
কোম্পানিটি জানিয়েছে, আমেরিকান হিউম্যান সোসাইটি কর্তৃক এই স্থানটি অনুমোদিত এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারে নিবন্ধিত।
ডায়ার উলফের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এর জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করেছেন, যেমন সাদা লোম এবং লম্বা, ঘন পশম। এরপর তারা ধূসর নেকড়ের কোষে এই বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করেন।
১৪টি জিনের প্রায় ২০টি পরিবর্তন করে, তারা সবচেয়ে উপযুক্ত কোষ সারিগুলো ক্লোন করেন এবং সেগুলোকে অন্য প্রাণীর ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করেন। এর ফলে তিনটি শাবকের জন্ম হয়।
কোম্পানিটি সরাসরি না জানালেও, বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে যে তারা সারোগেট (surrogate) হিসেবে কুকুরের সাহায্য নিয়েছিল।
তবে, এই ধরনের গবেষণা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি পুনরুদ্ধারের চেয়ে বিদ্যমান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তাছাড়া, সারোগেট হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণীদের সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দর্শনের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার প্রেসটন বলেছেন, “ডায়ার উলফদের বাস্তুতন্ত্রে কোনো ভূমিকা রাখা কঠিন। তাই, নতুন প্রাণীগুলো কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ।”
অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের বাঁচাতে কাজে লাগবে। কলোসাল বায়োসায়েন্সেস সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, তারা ডায়ার উলফের গবেষণায় তৈরি হওয়া নতুন ক্লোনিং পদ্ধতির মাধ্যমে লাল নেকড়ের (সবচেয়ে বিপন্নপ্রায় নেকড়ে প্রজাতি) দুটি শাবক তৈরি করেছে।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর প্যালিওজেনেটিক্সের অধ্যাপক লাভ ডালেনের মতে, “জিনগতভাবে এই নেকড়েগুলো ৯৯.৯% ধূসর নেকড়ের মতোই। তবে, এদের মধ্যে ডায়ার উলফের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং তারা দেখতেও সেই প্রজাতির মতোই।”
মোটকথা, ডায়ার উলফকে ফিরিয়ে আনার এই প্রচেষ্টা একদিকে যেমন বিজ্ঞানীদের সাফল্যের দৃষ্টান্ত, তেমনি এটি পরিবেশ এবং প্রাণী সংরক্ষণে নতুন সম্ভাবনাও তৈরি করেছে।
তবে, এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই বিবেচনা করতে হবে এবং বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে একটি উপযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন