বন্দর নগরী সাউদাম্পটন: টাইটানিকের স্মৃতি আর বিশ্ব ভ্রমণের প্রবেশদ্বার।
প্রায় দু’হাজার বছর ধরে সাউদাম্পটন শহরটি বিশ্ব বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ইংল্যান্ডের এই বন্দর নগরী শুধু একটি শহর নয়, বরং এটি ইতিহাসের সাক্ষী।
আধুনিক আমেরিকার গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে সমুদ্র ইতিহাসের এক গভীর শোকের ঘটনা—সবকিছুতেই এই শহরের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। এমনকি আধুনিক যুগের বিশাল ক্রুজ শিল্পখাতটির জন্মও এই শহরেই।
সাউদাম্পটন, ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের একটি সুরক্ষিত উপসাগরের তীরে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে জাহাজ আসা-যাওয়া করত।
বণিক, অভিবাসী, পর্যটক, এমনকি আক্রমণকারীরাও এই পথ ব্যবহার করেছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে, সাউদাম্পটন দ্রুতই সমুদ্রগামী জাহাজের ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক, হামবার্গ এবং সিডনির মতোই এই শহরের নামও বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।
ঐতিহাসিকদের মতে, এই শহরটি সবসময়ই “বিশ্বের প্রবেশদ্বার” হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে এই পরিচয় সব সময় সুখকর ছিল না।
ডেনিশ, ফ্লেমিশ এবং ফরাসিদের মতো বিভিন্ন শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছে এই শহর। ১৩৩৮ সালে ফরাসিদের আক্রমণে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পরেছিল, যার প্রমাণ আজও পাওয়া যায়।
একসময় যারা এখানে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকে আবার এই শহর দিয়েই বিশ্বজুড়ে পাড়ি জমিয়েছিল।
১৬২০ সালের ১৫ই আগস্ট, ‘মেফ্লাওয়ার’ জাহাজটি এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে, যা পরবর্তীতে আমেরিকায় অভিবাসীদের নিয়ে যায়।
সময়ের সাথে সাথে সাউদাম্পটনের গুরুত্ব কমে গেলেও, উনিশ শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালিত জাহাজের আগমন এর ভাগ্য বদলে দেয়। জার্মানির কাইজার উইলহেলম ডের গ্রোসের মতো বিশাল জাহাজ এবং ব্রিটিশ ‘লুসিটানিয়া’র মতো বিখ্যাত জাহাজগুলো এই বন্দর ব্যবহার করত।
এই সময় সাউদাম্পটন দ্রুত উন্নতি লাভ করতে শুরু করে।
এই শহরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল টাইটানিকের ঘটনা। ১৯১২ সালে সাউদাম্পটন থেকে যাত্রা শুরু করা ‘টাইটানিক’ ডুবে গেলে, শহরের প্রায় ৫০০ পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের হারায়।
‘সি সিটি মিউজিয়াম’-এ টাইটানিক বিষয়ক একটি প্রদর্শনীতে এই শোকের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি, শহরের ‘হোয়াইট স্টার’ নামক একটি পাব-এর নামও টাইটানিক কোম্পানির নামে রাখা হয়েছে।
আজও, সাউদাম্পটনের বন্দরে আসা পর্যটকদের মাঝে অতীতের সেই স্মৃতিগুলো যেন ভেসে বেড়ায়।
তবে সময়ের সাথে সাথে সবকিছু বদলে গেছে। বর্তমানে এখানে বিশাল আকারের ক্রুজ জাহাজগুলো ভিড় করে, যেখানে হাজার হাজার পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায়।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন এই জাহাজগুলো একদিকে যেমন ভ্রমণকে সহজ করেছে, তেমনি পরিবেশের উপর ফেলছে বাড়তি চাপ।
তবে শুধু জাহাজ আসা-যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সাউদাম্পটনের গল্প। এখানে বিভিন্ন দেশের মানুষের আগমন ঘটেছে, যা শহরটিকে আরও বৈচিত্র্যময় করেছে।
পঞ্চাশের দশকে অনেক চীনা নাবিক এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। এরপর ক্যারিবীয় এবং উগান্ডা থেকেও অনেকে এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে।
সাউদাম্পটন তাই শুধু একটি বন্দর নগরী নয়, এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনস্থল।
এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা এবং ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই শহর।
তথ্য সূত্র: সিএনএন