উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেনিও: অনাবিষ্কৃত এক রত্ন।
বিশ্বের অনেক শহরের ভিড়ে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেনিও যেন একটু আড়ালেই থাকে। তবে যারা এই শহরটি ঘুরে আসেন, তারা এর প্রেমে পড়েন নিশ্চিত।
প্লেট নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি বাউনোস আইরেসের মতোই, ফুটবল, ট্যাঙ্গো এবং বিশ্বমানের স্টেক-এর জন্য বিখ্যাত। তবে মন্টেনিও-র আসল আকর্ষণ এর সংস্কৃতি আর জীবনযাত্রার ভিন্নতা।
এখানে কফির বদলে ‘মেট’ নামক ভেষজ চা-এর প্রচলন বেশি, যা শহরটিকে দেয় এক বিশেষ পরিচিতি।
পুরোনো শহর সিউদাদ ভিয়েজা মন্টেনিও-র সবচেয়ে আকর্ষণীয় এলাকা। এক সময়ের দুর্গ-প্রাচীর ঘেরা এই জায়গাটি এখন পাথুরে রাস্তা, পাম গাছ আর পুরোনো বাড়ির সারিতে সজ্জিত।
বাড়িগুলোর দেয়ালে আঁকা হয়েছে বিশাল আকারের দেয়ালচিত্র আর গ্রাফিতি।
সিউদাদ ভিয়েজার বাইরে, শহরের কেন্দ্র পূর্বে বিস্তৃত। এখানে রয়েছে আধুনিক প্রেসিডেন্টের কার্যালয়, উনিশ শতকের প্রাসাদ, জাদুঘর এবং প্লাজা ইন্ডিপেন্ডেন্সিয়া।
দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্র উপকূল ধরে বিস্তৃত রাস্তাটি (Rambla) পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। এর একদিকে রয়েছে সমুদ্র, আর অন্য দিকে পোসিটোস, বুসিও এবং মালভিনের মতো সুন্দর এলাকা।
মন্টেনিও শুধু একটি শহর নয়, এটি সংস্কৃতিরও কেন্দ্র। ইউনেস্কো একে ‘সিটি অফ লিটারেচার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এখানে রয়েছে অসংখ্য বইয়ের দোকান। এখানকার মানুষের সংস্কৃতিতে সঙ্গীতের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে।
ট্যাঙ্গো নৃত্যের উৎপত্তিস্থলের মধ্যে মন্টেনিও অন্যতম। উনিশ শতকের শেষের দিকে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে এই নাচের উদ্ভব হয়।
এরপর ধীরে ধীরে আফ্রিকান, স্থানীয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে এটি আরও বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে, এখানে নানান ট্যাঙ্গো ক্লাব, ক্লাস এবং অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া যায়।
এখানে কান্দোম্বের মতো বিশেষ ধরনের সঙ্গীতের প্রচলন রয়েছে। কান্দোম্বে মূলত আফ্রিকার দাসদের উত্তরসূরীদের মধ্যে প্রচলিত একটি সংস্কৃতি, যা ইউনেস্কো কর্তৃক মন্টেনিও-র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
এর প্রধান বাদ্যযন্ত্রগুলো হলো পিয়ানো, রিপিকে এবং চিকো নামক ড্রাম। কান্দোম্বে সারা বছর ধরেই পরিবেশিত হয়, তবে এখানকার দীর্ঘ কার্নিভালে এর প্রধান আকর্ষণ থাকে।
জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চলা এই উৎসবে প্যারেড, বিভিন্ন প্রদর্শনী আর পার্টি অনুষ্ঠিত হয়।
মন্টেনিও এখনও পর্যটকদের কাছে খুব পরিচিত নয়। তবে ২০৩০ ফিফা বিশ্বকাপ-এর উদ্বোধনী ম্যাচ আয়োজনের সুবাদে এই শহরের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে আরও বাড়বে।
দর্শনীয় স্থান
- মার্কাডো দেল পুয়ের্তো: সিউদাদ ভিয়েজার পাশে অবস্থিত, এই লোহার কাঠামোটি ভিক্টোরিয়ান যুগের একটি রেল স্টেশনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে অনেক স্টেকহাউস রয়েছে, যেখানে বিনামূল্যে ‘মেডিও ই মেডিও’ (সাদা ও মিষ্টি ওয়াইনের মিশ্রণ) পরিবেশন করা হয়।
- প্যালাসিও সালভো: প্লাজা ইন্ডিপেন্ডেন্সিয়া-র উপরে অবস্থিত, এই বিশাল টাওয়ারটি একসময় দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল। এর স্থাপত্যশৈলী বিভিন্ন ধরনের, যেমন গথিক থেকে আর্ট নুভো পর্যন্ত।
- ভিজ্যুয়াল আর্টস জাদুঘর: পার্ক রোদোতে অবস্থিত এই জাদুঘরে উরুগুয়ের শিল্পীদের আঁকা ছবি, প্রিন্ট, ভাস্কর্য, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম রয়েছে।
- রাম্বলা: মন্টেনিও-র উপকূল ধরে প্রায় ১৪ মাইল দীর্ঘ এই রাস্তাটি বিশ্বের দীর্ঘতম হাঁটা পথের একটি।
- এস্তাদিও সেন্টেনারিও: ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে উরুগুয়ে জয়লাভ করে।
- ক্যাস্টিলো পিটামিগলিও: মন্টেনিও-র সবচেয়ে অদ্ভুত স্থাপত্যগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।
খাবার
- ক্যাফে ব্রাসিলিরো: ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাফেটি সিউদাদ ভিয়েজাতে অবস্থিত। উরুগুয়ের লেখক এডুয়ার্ডো গ্যালিয়ানো এখানে আসতেন। এখানে সকালের নাস্তার জন্য কফি ও মিডিয়ালাউনা (ক্রোয়াস্যান্ট) পাওয়া যায়।
- এসকারামুজা: কর্ডন এলাকার একটি বইয়ের দোকানের পেছনে অবস্থিত এই ক্যাফে-রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ধরনের খাবার পাওয়া যায়।
- ক্যাবান্যা ভেরোনিকা: মার্কাডো দেল পুয়ের্তোতে অবস্থিত এই স্টেকহাউসে চমৎকার স্টেক পাওয়া যায়।
থাকার জায়গা
- হোটেল প্যালাসিও: সিউদাদ ভিয়েজার পাশে অবস্থিত এই হোটেলে পুরনো দিনের অনেক বৈশিষ্ট্য এখনও বিদ্যমান।
- হোটেল কোস্টানুরো মন্টেনিও – এমগ্যালারি: পোসিটোস এলাকার এই হোটেলে সমুদ্রের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।
- আলমা হিস্টোরিকা বুটিক হোটেল: সিউদাদ ভিয়েজার একটি প্লাজায় অবস্থিত, এটি একটি পুরনো বাড়ির আদলে তৈরি।
কেনাকাটা
- আলফাহোরেস: দুটি বিস্কিটের মাঝে ‘ডুলসে দে লেচে’ (দুধ থেকে তৈরি মিষ্টি) দিয়ে তৈরি আলফাহোরেস উরুগুয়ের একটি জনপ্রিয় খাবার।
- ফেরিয়া দে ত্রিস্তান নারভাজা: প্রতি রবিবার কর্ডন এলাকায় এই বাজারে নানান জিনিস পাওয়া যায়।
- উলের পোশাক: এখানে উলের তৈরি সুন্দর পোশাক পাওয়া যায়।
রাতের জীবন
- প্রাইমিউসিয়াম: এটি জাদুঘর, রেস্টুরেন্ট এবং ট্যাঙ্গো ক্লাবের সমন্বয়ে গঠিত।
- তেয়াট্রো সোলিস: উরুগুয়ের প্রধান কনসার্ট হল এটি।
- বার তাবার: এটি ১৯১৯ সালে একটি সাধারণ দোকান ও বার হিসেবে খোলা হয়েছিল।
স্থানীয়দের মতো অভিজ্ঞতা
- কান্দোম্বে: কার্নিভাল মিস করলে, আপনি এখানকার পার্কে কান্দোম্বের অনুশীলন দেখতে পারেন।
- চিভিটো: এটি গরুর মাংসের স্যান্ডউইচ, যা উরুগুয়ের একটি ক্লাসিক খাবার।
- ফুটবল: মন্টেনিও-র সংস্কৃতি উপভোগ করার অন্যতম উপায় হলো ফুটবল ম্যাচ দেখা।
মন্টেনিও-র আকর্ষণীয় স্থানগুলো একদিকে যেমন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে, তেমনি সেখানকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
যারা নতুন কিছু দেখতে ও জানতে চান, তাদের জন্য মন্টেনিও হতে পারে একটি আদর্শ গন্তব্য।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক