যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি কি সত্যিই ইতিহাসের বৃহত্তম কর বৃদ্ধি? এমন প্রশ্ন এখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পরিচিত শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এই বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় দলের রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এই নিয়ে ভিন্নমত দেখা যাচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট গভর্নর গ্যাভিন নিউসম ২রা এপ্রিল সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ এক পোস্টে লেখেন, “ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় কর বৃদ্ধি করেছেন।” তার এই মন্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে ইলিনয়ের গভর্নর জে বি প্রিটজকার, সিনেটর চাক শুমার এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য জ্যারেড মস্কোভিটজও একই কথা বলেছেন। এমনকি রিপাবলিকান দলের সদস্য মাইক পেন্সও এটিকে “যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শান্তিকালীন সময়ে বৃহত্তম কর বৃদ্ধি” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জানা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন প্রায় সব দেশের উপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই তালিকায় থাকা দেশগুলোকে ১০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে, আর কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক বৃদ্ধিকে কর হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কারণ, এটি যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা পণ্যের উপর ধার্য করা হয়। ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের ফেডারেল ট্যাক্স পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট এরিকা ইয়র্ক বলেন, “শুল্ক হলো আমদানি শুল্ক, যা অন্য দেশ থেকে পণ্য ও উপকরণ কেনার সময় ব্যবসায়ীদের দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই এই বর্ধিত খরচ ভোক্তাদের উপর চাপিয়ে দেয়।”
তবে, এই শুল্ক বৃদ্ধির পরিমাণ নিয়ে বিভিন্ন হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কের হার নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, ফলে এই পরিকল্পনা পরিবর্তন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, এই শুল্ক বৃদ্ধি গত প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এমনকি, কিছু হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫১ সালের পর এটি বৃহত্তম কর বৃদ্ধি।
শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব পরিমাপ করার একটি উপায় হলো নতুন গড় কার্যকর শুল্ক হারের সঙ্গে আগের হারগুলোর তুলনা করা। ট্যাক্স ফাউন্ডেশন, ইয়েল বাজেট ল্যাব এবং জেপি মরগান চেজ-এর মতো বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা নতুন শুল্ক হার ১৬.৫ শতাংশ, ২২.৫ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে। এই হারগুলো প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে গড় কার্যকর শুল্ক হার ছিল ২.৪ শতাংশ।
আরেকটি উপায় হলো রাজস্ব সংগ্রহের হিসাব করা। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি দিয়েছে, শুল্কের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়লে অন্যান্য ফেডারেল ট্যাক্স কমানো যেতে পারে। তবে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ শুল্ক সাধারণ আমেরিকানদের জন্য উল্লেখযোগ্য কর হ্রাসের জন্য যথেষ্ট রাজস্ব তৈরি করতে পারবে না।
হোয়াইট হাউজের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এক সাক্ষাৎকারে জানান, অটোমোবাইল খাতের বাইরের শুল্ক বছরে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার এবং ১০ বছরে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রাজস্ব বাড়াতে পারে। এছাড়া, অটোমোবাইল শুল্ক থেকে বছরে আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে, এই হিসাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এরিকা ইয়র্ক মনে করেন, নাভারোর হিসাব সঠিক নয়। কারণ, শুল্ক আমদানি কমিয়ে দেবে এবং এর ফলে আয়কর ও বেতন করের পরিমাণও কমবে।
ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের মতে, ২০২৫ সালের জন্য রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ হতে পারে ২৫৮.৪ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ০.৮৫ শতাংশ। এটি ১৯৮২ সালের পর বৃহত্তম কর বৃদ্ধি হবে। জেপি মরগান চেজ-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মাইকেল ফেরোলির হিসাব অনুযায়ী, এই পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ১.৩ শতাংশ। তাঁর মতে, এটি ১৯৬৮ সালের পর বৃহত্তম কর বৃদ্ধি। সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডিন বেকার মনে করেন, কিছু রাজস্বের হিসাব অনেক কম। তাঁর মতে, প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার কর রাজস্ব আসতে পারে।
এই শুল্ক নীতির কারণে বিশ্ব বাণিজ্য এবং বাংলাদেশের উপরও এর কিছু প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধি পেলে তা ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং ভোক্তাদের উপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা