বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য কমার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না, যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়ছে দ্রুতগতিতে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪০ শতাংশের বেশি এসেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। এর মূল চালিকাশক্তি ছিল সৌর বিদ্যুৎ, যা ২০১২ সাল থেকে প্রতি তিন বছর পরপর দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। জলবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, সেই তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন সেভাবে না বাড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এখনো কমেনি, বরং তা বাড়ছে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এমবার (Ember)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিল ম্যাকডোনাল্ডের মতে, “সৌর বিদ্যুৎ বৈশ্বিক জ্বালানি রূপান্তরের ইঞ্জিন হয়ে উঠেছে। দ্রুত বর্ধনশীল এবং নতুন বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে এটি বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর বিশ্বজুড়ে রেকর্ড তাপমাত্রা দেখা গিয়েছিল, ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায় প্রায় ৪ শতাংশ। এতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণও বাড়ে, যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় তা অনেক কম ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোতে তথ্যকেন্দ্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA)-এর তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব কমাতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ২৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ কমাতে হবে। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ২০৩০ সালের শুরুতেই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বছরে প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে উন্নত গ্রিড ব্যবস্থা তৈরি করাও জরুরি। কারণ, গ্রিড দুর্বল হলে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এমবারের প্রতিবেদনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার একটি বড় পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে চীন সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে। গত বছর গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের পরিমাণ ছিল ১,৮৬৫ টেরাওয়াট ঘণ্টা (TWh), যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাশিয়ার চেয়ে তিনগুণের বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে (European Union) গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে, যা টানা পাঁচ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
আইইএ (IEA)-এর মতে, বিশ্বে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে তিনগুণ বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে, জ্বালানি ব্যবহারের দক্ষতা দ্বিগুণ করা, মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ৭৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি ও হিটিং পাম্পের বিক্রি বাড়াতে হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা