গাজায় মানবিক বিপর্যয়: জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘মৃত্যুফাঁদ’ মন্তব্য, অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গাজা উপত্যকার ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি একে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য একটি “অন্তহীন মৃত্যুফাঁদ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইসরায়েলি অবরোধ এবং অবিরাম বোমা হামলার কারণে সেখানকার মানুষজন চরম দুর্দশার শিকার হচ্ছে।
জরুরি ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
মঙ্গলবার (২৬ মার্চ) সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে গুতেরেস গাজায় ত্রাণ সরবরাহের ওপর ইসরায়েলের নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, এই প্রস্তাব সাহায্যকে “আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ” এবং “খাবার ও আটার শেষ কণা পর্যন্ত” সীমিত করার ঝুঁকি তৈরি করবে।
গুতেরেস স্পষ্টভাবে জানান, “আমরা এমন কোনো ব্যবস্থায় অংশ নেব না যা মানবিক নীতিগুলো- মানবিকতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা এবং নির্লিপ্ততাকে সম্পূর্ণরূপে সম্মান করে না।
গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ সরবরাহ করা হয়নি। খাদ্য, জ্বালানি, ঔষধপত্র এমনকি বাণিজ্যিক সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুতেরেস বলেন, “সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিভীষিকার দুয়ার খুলে গেছে। গাজা একটি ‘মৃত্যু উপত্যকা’য় পরিণত হয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকরা একটি অন্তহীন মৃত্যুচক্রে আটকা পড়েছে।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী, যা অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের বেসামরিক বিষয়গুলোর জন্য দায়ী, জাতিসংঘের সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সাথে বৈঠক করেছে। তারা জানিয়েছে, গাজায় “একটি কাঠামোবদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ প্রবেশ প্রক্রিয়া” প্রস্তাব করেছে। তাদের দাবি, হামাস বেসামরিক নাগরিকদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে।
তবে জাতিসংঘের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জোনাথন হুইটল, যিনি গাজা ও পশ্চিম তীরে ত্রাণ কার্যক্রমের দায়িত্বে আছেন, তিনি জানিয়েছেন, ত্রাণ সরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে, যা দুই মাসের একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতিকে ভেঙে দিয়েছে। তারা গাজার কিছু অংশ দখলেরও চেষ্টা করছে। গুতেরেস বলেন, “অন্যদিকে, সীমান্ত ক্রসিংগুলোতে খাদ্য, ঔষধ ও আশ্রয় সামগ্রী জমে আছে এবং জরুরি সরঞ্জাম আটকে রয়েছে।
জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদক গ্যাব্রিয়েল এলিজন্ডো জানিয়েছেন, গুতেরেস সম্ভবত এই প্রথম গাজার পরিস্থিতি নিয়ে এত কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়ে গেছে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
গুতেরেস তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি গাজায় একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা সামগ্রীর পূর্ণ প্রবেশাধিকার এবং ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তির জন্য আবারও আহ্বান জানিয়েছেন।
গুতেরেস বলেন, “গাজায় প্রবেশপথগুলো বন্ধ এবং সাহায্য আটকে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং আমাদের সহায়তা প্রদানের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ হলো, ইসরায়েলকে ত্রাণ কর্মসূচি সহজতর করতে হবে এবং গাজায় খাদ্য, চিকিৎসা সেবা, স্বাস্থ্যবিধি ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এর কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গাজায় ত্রাণ পাঠানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান, মিশরের এল-আরিশ শহর সফর করেন। তিনি ইসরায়েলকে ত্রাণ সরবরাহের অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে মিলিত হয়ে ম্যাক্রোঁ গাজা উপত্যকার পশ্চিমে অবস্থিত একটি হাসপাতালে যান। সেখানে তিনি চিকিৎসা পেশাজীবী ও গাজা থেকে সরিয়ে আনা আহত ফিলিস্তিনিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
রোগীদের দেওয়ার জন্য একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন এবং শিশুদের খেলার স্থানে যান। তার কার্যালয় জানিয়েছে, এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে গাজায় মানবিক ত্রাণ সামগ্রী প্রবেশের জন্য ক্রসিং পয়েন্টগুলো খুলে দেওয়া হয়।
হাসপাতালের চিকিৎসক মাহমুদ মোহাম্মদ এলশায়ের জানান, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে হাসপাতালটিতে প্রায় ১,২০০ ফিলিস্তিনি রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “কিছু দিন আমরা ১০০ জন রোগী পাই, আবার কোনো দিন ৫০ জন।” তাদের মধ্যে অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে অথবা চোখ ও মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে।
এদিকে, কায়রোতে ম্যাক্রোঁ, আল-সিসি এবং জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ দ্বিতীয় এক বৈঠকে মিলিত হয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। তারা সোমবার (২৫ মার্চ) এই যুদ্ধ এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘবের মানবিক প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেন। উল্লেখ্য, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় ৫০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
সেখানকার বিপুল পরিমাণ ভূমি ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা