দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইন জগতে পরিবর্তনের হাওয়া, সাফল্যের পথে কৃষ্ণাঙ্গ বিজয়ীরা।
ঐতিহ্যগতভাবে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য থাকলেও, দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইন শিল্পে এখন পরিবর্তনের সুর। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের (winemakers of color) আগমন ঘটছে, যা এই শিল্পের চিরাচরিত ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।
কেপ উইনমেকার্স গিল্ড (Cape Winemakers Guild – CWG) প্রোটেজে প্রোগ্রাম-এর মতো কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের তরুণ ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় নতুন গ্র্যাজুয়েটরা দেশের স্বনামধন্য ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। এর ফলস্বরূপ, কিয়ারা স্কট ফার্মারের মতো অনেকেই সাফল্য লাভ করেছেন।
কিয়ারা সম্প্রতি ‘ডিনার্স ক্লাব ওয়াইনমেকার অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন।
আরেকজন তরুণ ওয়াইন প্রস্তুতকারক রুডগার ভ্যান ওয়াইক। তিনি স্টারক-কন্ডে (Stark-Condé) -এর প্রধান ওয়াইন প্রস্তুতকারক হিসেবে কাজ করার পর নিজের ব্র্যান্ড ‘নিউ ডন’ শুরু করেন। রুডগার বলেন, “২০২০ সাল পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।”
এই শিল্পের পথে চলা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির গল্প অনুপ্রেরণামূলক। বেরিন সোলস নামের একজন নারী, যিনি অত্যন্ত রুচিশীল বার্গান্ডি-স্টাইলের পিনোট নয়ার তৈরি করেন, যার একটি বোতলের দাম ৪০ পাউন্ডের বেশি। তিনি একসময় দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা ওয়াইন অঞ্চলে, হেমেল-এন-আর্ডে, একজন আয়া হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর কেরানি এবং পরবর্তীতে ওয়াইন তৈরির দলে যোগ দেন।
সবশেষে তিনি নিজের ব্র্যান্ড ‘টেসেলার্সডাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেইসি ডলামিনিও একইভাবে কঠোর পরিশ্রম করে ‘হার’ নামে একটি ওয়াইনারি শুরু করেছেন, যেখানে সব কর্মীই কৃষ্ণাঙ্গ নারী।
এই সাফল্যের পথে বাধাগুলোও কম নয়। রুডগার বলেন, “কৃষ্ণাঙ্গ ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের অনেকেরই বংশ পরম্পরায় চাষাবাদের অভিজ্ঞতা নেই, যা এই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান দেয়।” এছাড়াও, জমি ও উন্নত মানের ফল পাওয়াটাও কঠিন।
যুক্তরাজ্যের এমজে ওয়াইন সেল্য়ার্সের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাগস জ্যানজো বলেন, “ঐতিহাসিক ও আর্থ-সামাজিক কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় জমি মালিকানা ও ভালো মানের ফল পাওয়া বেশ কঠিন। এমনকি যারা ধনী পরিবার থেকে আসে, তাদেরও ওয়াইন প্রস্তুতকারক হিসেবে সফল হতে অনেক বেগ পেতে হয়, সেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য এই পথ আরও কঠিন।”
তবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষ্ণাঙ্গ ওয়াইন প্রস্তুতকারকদের এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। রুডগার মনে করেন, তরুণদের সাহায্য করা তাঁর দায়িত্ব। “আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা উচিত।”
আসুন, এমন কয়েকজন ওয়াইন প্রস্তুতকারকের তৈরি করা কিছু অসাধারণ ওয়াইনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক:
- **আমান্ডলা আওয়ার ফিউচার সভিগনন ব্ল্যাঙ্ক ২০২৩/২৪ (Amandla Our Future Sauvignon Blanc 2023/24):** প্রেইসি ডলামিনি ও তাঁর দলের তৈরি এই সভিগনন ব্ল্যাঙ্ক-এর দাম প্রায় ৯.৫০ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ১৩০০ টাকা)। এটি গ্রিল করা চিংড়ি অথবা সি-ফুড ও সালাদের সঙ্গে পরিবেশন করা যেতে পারে।
- **কারা তারা চারডনয়ে ২০২২ (Kara Tara Chardonnay 2022):** রুডগার ভ্যান ওয়াইকের তৈরি এই ক্রিমি চারডনয়ের দাম প্রায় ২৪.৪৯ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৩,৪০০ টাকা)। মাশরুম বা ক্রিম-যুক্ত খাবারের সঙ্গে এটি দারুণ মানানসই।
- **ব্রুকডেল সিক্সটিন ফিল্ড ব্লেন্ড ২০২৩ (Brookdale Sixteen Field Blend 2023):** কিয়ারা স্কট ফার্মারের তৈরি এই আকর্ষণীয় ফিল্ড ব্লেন্ডের দাম প্রায় ২৬.৯৯ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৩৭০০ টাকা)।
- **টেসেলার্সডাল পিনোট নয়ার ২০২৩ (Tesselaarsdal Pinot Noir 2023):** বেরিন সোলসের তৈরি এই অসাধারণ পিনোট নয়ার-এর দাম প্রায় ৪৬ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৬৪০০ টাকা)। হাঁসের মাংসের সঙ্গে এটি পরিবেশন করা যেতে পারে।
- **এম’হুদি ফ্যামিলি বুটিক পিনোটেজ ২০২১ (M’hudi Family Boutique Pinotage 2021):** দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ-মালিকানাধীন ওয়াইন ফার্মের তৈরি এই পিনোটেজের দাম প্রায় ২২.৯৯ পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় আনুমানিক ৩২০০ টাকা)। বারবিকিউ-এর জন্য এটি উপযুক্ত।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইন শিল্পে কৃষ্ণাঙ্গদের এই উত্থান শুধু একটি পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি নতুন দিগন্তের সূচনা। এটি প্রমাণ করে, ইচ্ছাশক্তি থাকলে প্রতিকূলতাকে জয় করে সাফল্যের শিখরে ওঠা সম্ভব।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক