ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা চলতেই থাকে। সম্প্রতি আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ইসরায়েলের তথাকথিত ‘গণতন্ত্রপন্থী’ আন্দোলনের সমালোচনা করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, এই আন্দোলন মূলত ইসরায়েলি-দের অধিকার রক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী, যা ফিলিস্তিনি জনগণের মানবিক অধিকারের প্রতি চরমভাবে উদাসীন।
নিবন্ধে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। গত বছরখানেক ধরে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালেও, আদালত কার্যত সরকারপক্ষকে সহায়তা করতে দেখা গেছে।
এমনকি যখন গাজায় খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, তখনও আদালতের সিদ্ধান্ত ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে পাঁচটি মানবাধিকার সংস্থা গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য ইসরায়েলি সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলার আবেদন জানায়। ওই সময় গাজায় প্রবেশ করা সহায়তার পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য, যা সেখানকার জনগণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে যথেষ্ট ছিল না।
জানা যায়, গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাজায় সহায়তা, সরঞ্জাম এবং কর্মী পাঠানোর ওপর থেকে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। বিশেষ করে উত্তর গাজায় শিশুদের অপুষ্টি ও পানিশূন্যতায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
আদালত দীর্ঘ এক বছর ধরে কোনো রায় দেয়নি, যা কার্যত সরকারকে সহায়তা বন্ধের বিষয়ে ছাড় দিয়েছে। যখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো আদালতের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের আবেদন জানায়, তখন আদালত সরকারের কাছে আরও তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে বলে।
সরকার শুরুতে দাবি করে যে তারা যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা পাঠাচ্ছে। কিন্তু পরে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, উত্তর গাজায় আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা তারা কম করে মূল্যায়ন করেছে, যার ফলে প্রয়োজনীয় সহায়তা সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
২০২৫ সালের মার্চ মাসে, যখন ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গাজায় পুনরায় বোমা হামলা শুরু করে এবং জ্বালানি ও অবকাঠামো মন্ত্রী গাজায় বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেন, তখনও মানবিক সহায়তার প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এরপরও আদালত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়।
অবশেষে, এক বছর পর, ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ আদালত রায় দেয়, যা আবেদনটির বিরুদ্ধে যায়। প্রধান বিচারপতি ইয়েজহাক অমিত এবং বিচারপতি নোয়াম সোলবার্গ ও ডেভিড মিন্টজ এই রায়ের পক্ষে মত দেন।
বিচারপতি ডেভিড মিন্টজ তার রায়ে ইহুদি ধর্মীয় শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ইসরায়েলের আক্রমণকে ঐশ্বরিক কর্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, এমনকি হামাসের হাতে সহায়তা যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারা তা অব্যাহত রেখেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো যখন বারবার অপুষ্টি ও খাদ্য সংকটের কথা জানাচ্ছিল, তখন ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট তাদের আবেদনের প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। বরং তারা এমন একটি রায় দিয়েছে, যা গাজাবাসীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য সামগ্রী থেকে তাদের বঞ্চিত করার শামিল।
সমালোচকরা বলছেন, আদালতের এই ভূমিকা যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহারকে বৈধতা দিয়েছে।
নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে ইসরায়েলে যে ‘গণতন্ত্রপন্থী’ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, তা মূলত ইহুদি-দের অধিকার রক্ষার জন্য। এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই গাজায় মানবিক সহায়তার বিষয়ে আদালতের বিতর্কিত রায় অথবা ইসরায়েলি বর্ণবাদ এবং ঔপনিবেশিক নীতির প্রতি আদালতের সমর্থনের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেন না।
তাদের মূল লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলের ইহুদি নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের অধিকার উপেক্ষিত হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা