গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থী কিনা, সেই বিষয়ে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে ইসরায়েল বিভিন্ন সময়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ মাসের ২৪ তারিখে গাজার উত্তরে আল জাজিরার সাংবাদিক হোসাম শাবাতকে হত্যা করা হয়। নিহত ২৩ বছর বয়সী শাবাতসহ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশু।
ইসরায়েল প্রায়ই এই ধরনের হামলার পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকে, তাদের নিশানায় থাকা ব্যক্তিরা হয় হামাস অথবা অন্য কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। হোসাম শাবাতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, হামাস যোদ্ধাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল প্রায়ই পুরো এলাকা কিংবা ভবন গুড়িয়ে দেয়। এর ফলে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটে।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মকাণ্ডের পক্ষে একটি “আইনি ভিত্তি” তৈরির চেষ্টা করছে, যার মাধ্যমে তারা নতুন এবং বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছে।
টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক হাইডি ম্যাথিউস আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ কৌশলকে কোনোভাবেই আইনের আওতায় আনা যায় না।
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের নিপীড়নের প্রতিবাদে ২০০০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর পশ্চিম তীর ও গাজায় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। এরপর থেকে ইসরায়েল “টার্গেটেড কিলিং” নামে পরিচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে শুরু করে।
ইসরায়েলের দাবি ছিল, নিহত ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে ইসরায়েলিদের জন্য হুমকি হতে পারে।
লেবাননের একটি মানবাধিকার সংস্থা ‘লিগ্যাল এজেন্ডা’-র গবেষক নূর কিলজি বলেন, ইসরায়েল তার নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতেও তাদের নিরাপত্তা কেড়ে নেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের “টার্গেটেড কিলিং”-এর ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই যুক্তরাষ্ট্র তাদের তথাকথিত “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের” সময় একই কৌশল অবলম্বন করে।
ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাথিউস বলেন, “২০০০ সালের দিকে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের আইনি কাঠামো পরিবর্তন করে এবং সামরিক কার্যক্রমে এটি প্রয়োগ করতে শুরু করে। বেসামরিক এবং যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ই একটি গোষ্ঠীর সদস্যপদের ভিত্তিতে যে কাউকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (ICRC) মতে, কোনো ব্যক্তি যদি সরাসরি সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত থাকে, তবেই তাকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা যেতে পারে। সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকালে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাগুলোতে নিয়মিতভাবে ৯০০ কিলোগ্রামের বোমা ফেলা হয়েছে। এছাড়া, স্কুল, হাসপাতাল এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এসব হামলার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, তারা “বর্বরদের” বিরুদ্ধে একটি “ন্যায্য যুদ্ধ” পরিচালনা করছেন। তাদের মতে, হামাসকে ধ্বংস করাই প্রধান লক্ষ্য, এক্ষেত্রে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমানোর বিষয়টি গৌণ।
উনিশ শতকের জার্মান-মার্কিন সামরিক তাত্ত্বিক ফ্রান্সিস লাইবারের দর্শন এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যুদ্ধের নিয়মাবলী তৈরি করতে গিয়ে বলেছিলেন, কিছু যুদ্ধ “সভ্য জাতির নৈতিক অগ্রগতির” জন্য অপরিহার্য এবং দ্রুত জয়লাভের জন্য এমন কৌশল অবলম্বন করা দরকার, যা সম্ভবত বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের হতাহতের কারণ হবে।
লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসের আইন বিশেষজ্ঞ আলোনসো গুরমেন্ডি ডাংকেলবার্গ আল জাজিরাকে বলেন, “লাইবারের মতে, যুদ্ধ জয়ের জন্য যা কিছু সামরিকভাবে প্রয়োজনীয়, তাই বৈধ।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই ধরনের যুক্তি প্রায়ই দেওয়া হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ বলেন, গাজায় ছয় দিনের হামলায় ৬,০০০ বোমা নিক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল “যুদ্ধ দ্রুত শেষ করা”।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তৎকালীন মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারিও স্বীকার করেছিলেন, গাজায় হামলার সময় “লক্ষ্যের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতির দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল”।
২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) নেতানিয়াহু এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের বিরুদ্ধে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা এবং যুদ্ধকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর আগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) এক রায়ে জানায়, গাজায় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের যুদ্ধ-কৌশলের কারণে গণহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, আইসিসি এবং আইসিজের এই রায়গুলো প্রমাণ করে যে, ইসরায়েল তাদের যুদ্ধাপরাধকে বৈধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমানে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক পরিচালক এবং আরব রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা নাদিম খুরি বলেন, “ইসরায়েল আইনি যুক্তি ব্যবহার করে তাদের সীমা অতিক্রম করেছে। এখন তারা আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করতে সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সঙ্গে কাজ করছে।
বর্তমানে উদ্বেগের বিষয় হলো, নেতানিয়াহু সম্ভবত আইসিসির কাঠামোর সদস্যভুক্ত ইউরোপের দেশগুলোতে সফর করতে পারেন। হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলো জানিয়েছে, নেতানিয়াহু তাদের দেশে গেলে বা আকাশসীমা ব্যবহার করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না।
ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাথিউস মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইন সমর্থনকারী দেশগুলোকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে আইনের শাসন পুনরুদ্ধার করা যায়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা