রেকর্ড! শূকরের কিডনি নিয়ে ১৩০ দিন, অতঃপর…

শিরোনাম: শূকর থেকে প্রতিস্থাপিত কিডনি: মানুষের শরীরে সফল পরীক্ষার পর অপসারণ, নতুন দিগন্তের সূচনা

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে, জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ১৩০ দিন পর্যন্ত তা একজন মানুষের শরীরে কার্যকর ছিল। গত সপ্তাহে অঙ্গটি অপসারণ করা হলেও, এই ঘটনাটি প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের (xenotransplantation) গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার ৫৩ বছর বয়সী টাওয়ানা লুনি নামের এক নারীর দেহে এই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। দীর্ঘ নয় বছর ধরে ডায়ালাইসিস-এর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি তার মায়ের জীবন বাঁচাতে একটি কিডনি দান করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে প্রি-এক্লাম্পসিয়ার কারণে তার অবশিষ্ট কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের তালিকায় নাম লিখিয়েও কাঙ্ক্ষিত কিডনি পাচ্ছিলেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব আসে, এবং লুনি সেই সুযোগটি গ্রহণ করেন।

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির (NYU) ল্যাঙ্গোন ট্রান্সপ্লান্ট ইনস্টিটিউটে (NYU Langone Transplant Institute) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার শরীরে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি ছিল জীবিত অবস্থায় জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত শূকর থেকে কিডনি গ্রহণকারী তৃতীয় ব্যক্তি। অস্ত্রোপচারের ১১ দিন পর তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেন এবং প্রতিদিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যেতেন।

কিন্তু কয়েক মাস স্থিতিশীল থাকার পর, অপ্রত্যাশিতভাবে জটিলতা দেখা দেয়।

চিকিৎসকদের মতে, এপ্রিল মাসের শুরুতে তার কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পেতে শুরু করে, যা সম্ভবত প্রত্যাখ্যানের (rejection) কারণে হয়েছিল। তবে এর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা চলছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরে অন্য একটি সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর ফলে এই জটিলতা দেখা দেয়।

ঝুঁকি এড়াতে এবং ভবিষ্যতে অন্য কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা অক্ষুণ্ণ রাখতে চিকিৎসকরা কিডনি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন।

এই উদ্ভাবনের পেছনে থাকা ইউনাইটেড থেরাপিউটিক্স কর্পোরেশন (United Therapeutics Corporation) নামক একটি বায়োটেক কোম্পানি, টাওয়ানা লুনির সাহস ও আগ্রহের প্রশংসা করেছে। তাদের তৈরি করা পরিবর্তিত শূকরের কিডনির নাম ‘ইউকিডনি’ (UKidney)। কোম্পানিটির মতে, মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পর সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং প্রত্যাখ্যান প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ–এর ভারসাম্য বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

লুনির ক্ষেত্রে, ‘ইউকিডনি’ অপসারণের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, শূকরের কিডনি ভালোভাবে কাজ করছিল, কিন্তু সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর কারণে জটিলতা তৈরি হয়। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে নব্বই হাজারের বেশি মানুষ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করছেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের দীর্ঘসূত্রিতা এবং পর্যাপ্ত দাতার অভাবে অনেক রোগী সঠিক সময়ে চিকিৎসা পান না। ডায়ালাইসিস-এর মাধ্যমে রক্তের দূষিত পদার্থ অপসারণ করা গেলেও, এটি একটি স্থায়ী সমাধান নয়। ডায়ালাইসিস করা রোগীদের মধ্যে পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৫০ শতাংশ।

মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন (US Food and Drug Administration) ‘কম্প্যাশনেট ইউজ’ নীতির অধীনে শূকর থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। এই নীতির আওতায়, যখন অন্য কোনো কার্যকর চিকিৎসা উপলব্ধ থাকে না, তখন পরীক্ষামূলক চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ থাকে।

শূকরের অঙ্গ মানুষের শরীরের গঠনের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাছাড়া, শূকরের প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় খুব দ্রুত অঙ্গ সংগ্রহ করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা শূকরের জিন পরিবর্তন করে মানবদেহে অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছেন।

ইউনাইটেড থেরাপিউটিক্স কর্পোরেশন আশা করছে, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে তারা শেষ পর্যায়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের ওপর ‘ইউকিডনি’ ব্যবহারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে পারবে। প্রথম পর্যায়ে ৬ জন রোগীর ওপর এই পরীক্ষা চালানো হবে এবং পরে তা ৫০ জন পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টাওয়ানা লুনির মতো মানুষের ত্যাগের কারণেই আগামী এক দশকের মধ্যে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন একটি প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

বর্তমানে, বাংলাদেশেও প্রতি বছর বহু মানুষ কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও, চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। অনেক ক্ষেত্রে, উপযুক্ত দাতার অভাবে রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। তাই, শূকর থেকে মানুষের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো নতুন উদ্ভাবনগুলো এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *