ফিলিস্তিনি প্যারামেডিকদের হত্যা: ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতা ফাঁস!

গাজায় ফিলিস্তিনের প্যারামেডিক ও উদ্ধারকর্মীদের হত্যা: ইসরায়েলি সেনা ইউনিটের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত মাসে গাজা উপত্যকায় ১৫ জন ফিলিস্তিনি প্যারামেডিক ও উদ্ধারকর্মীকে হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফের একটি ইউনিটের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগের তীর সেই ইউনিটের দিকে, যারা ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছে গোলানি ব্রিগেডের একটি দল, যাদের কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইহুদা ভাচ। এই জেনারেলের বিরুদ্ধে আগে থেকেই মানব জীবনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের অভিযোগ ছিল।

সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, গত ২৩শে মার্চ রাফাহ শহরে দুটি অ্যাম্বুলেন্স বহরে গুলি চালায় গোলানি ব্রিগেডের সেনারা। এরপর নিহতদের মরদেহ লুকানোর জন্য গণকবর খোঁড়া হয়। জাতিসংঘের একটি দল পরে সেখান থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে উঠে এসেছে, নিহতদের অনেকের মাথায় ও বুকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে এবং তাদের হাত ও পা বাঁধা ছিল।

ঘটনার সময় সেখানে ইউনিটের ৫0৪-এর সদস্যরাও উপস্থিত ছিল। এই ইউনিট জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিষ্ঠুরতা ও বেপরোয়া আচরণের জন্য পরিচিত।

অভিযোগ উঠেছে, রাফাহর ওই হামলায় গোলানি ব্রিগেডের সেনারা রিজার্ভ আর্টিলারি ১৪তম ব্রিগেডের অধীনে কাজ করছিল। ১৪তম ব্রিগেড আবার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইহুদা ভাচের নেতৃত্বাধীন একটি বিভাগের অংশ। প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তাদের মতে, জেনারেল ভাচ গাজায় একটি ‘হত্যা জোন’ তৈরি করেছিলেন, যেখানে নির্বিচারে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে।

এমনকি, জেনারেলের ‘অপারেশনাল শৃঙ্খলা’র অভাব সেনাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনারেল ভাচ সৈন্যদের বলেছিলেন, ‘গাজায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নেই’।

ইসরায়েলের চ্যানেল ১৪-এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গোলানি ব্রিগেডের সৈন্যদের গাজায় পুনরায় মোতায়েন করার আগে এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তাদের উদ্দেশে বলছেন, ‘সেখানে যাদেরই দেখবে, সে-ই শত্রু। যে কাউকে চিহ্নিত করবে, তাকেই খতম করবে।’

গোলানি সেনারা আগেও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, লাশের অবমাননা, বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস এবং গণহত্যার উসকানির মতো অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে।

হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গোলানি ব্রিগেডের ৫১তম ব্যাটালিয়নের এক সদস্যের লেখা একটি গান অনেক সেনার কাছে এখন একরকমের ‘অফিসিয়াল সঙ্গীতে’ পরিণত হয়েছে। গানের একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েল জাতির প্রতি তোমরা যা করেছ, তার জন্য গোলানি আসছে পেট্রল নিয়ে… গাজা জ্বলবে’। গানের ভিডিওতে গোলানি ব্রিগেডের সদস্যদের গাজায় অভিযানের দৃশ্য দেখানো হয়েছে।

হিন্দ রাজাব ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কাজ করে, তাদের আইনি নথিতে গোলানি সেনাদের বিরুদ্ধে আনা অনেক অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেনাদের পোস্ট করা ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অবশ্য এই ফাউন্ডেশনের দুই প্রতিষ্ঠাতার চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস রয়েছে বলে দাবি করেছেন।

গণহত্যার একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক মুনথের আবেদের বয়ানেও ইউনিট ৫0৪-এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্প্রতি রাফায় আইডিএফের অভিযানের সরকারি ছবি ও ভিডিওতেও এর সমর্থন পাওয়া গেছে।

ইউনিট ৫0৪-এর সেনারা যুদ্ধকালে গাজার বন্দীদের হাজার হাজার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা অন্যান্য ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ভিন্ন, কারণ এর সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি লড়াই করে এবং তারা সাবলীলভাবে আরবি বলতে পারে।

আবেদ জানান, ঘটনার সময় তিনি যে অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন, সেটিকে প্রথমে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এতে তাঁর সঙ্গে থাকা চালক ও প্যারামেডিক নিহত হন। এরপর সৈন্যরা তাঁকে একটি জরুরি গাড়ী থেকে টেনে বের করে।

তাঁর পরনের কাপড় খুলে ফেলা হয়, হাত পিছনে বাঁধা হয় এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ।

ঘটনার পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের আগের বক্তব্য থেকে সরে আসে। প্রথমে তারা দাবি করেছিল, রেড ক্রিসেন্টের গাড়িগুলোতে জরুরি সংকেত ছিল না এবং আলোও জ্বলছিল না। পরে সেই দাবিকে অস্বীকার করে তারা।

আইডিএফ জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ছয় থেকে নয় জনের হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তবে এর কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেনি।

নিহত আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, গাজা সিভিল ডিফেন্সের ছয় সদস্য এবং ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) একজন কর্মচারী ছিলেন। রেড ক্রিসেন্টের একজন কর্মী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামির এই ঘটনার একটি বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে।

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এই ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের হামলায় ছয়জন কর্মী নিহত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির সদস্যদের ওপর এটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক হামলা।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *