পানামার বিরোধী দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশটির উপর ‘ছদ্মবেশী আগ্রাসন’-এর অভিযোগ এনেছে। দেশটির সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে এই অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের পানামা সফরের পরই এই বিতর্ক আরও বাড়ে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের তিন দিনের পানামা সফরের পর, ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্র পানামায় প্রচুর সৈন্য পাঠিয়েছে। হেগসেথ জানান, চীনের প্রভাব থেকে পানামা খাল রক্ষার জন্য তারা প্রাক্তন তিনটি মার্কিন ঘাঁটিতে সামরিক উপস্থিতি বাড়াবে।
পানামার বিরোধীদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র আসলে ‘ছদ্মবেশী আগ্রাসন’ চালাচ্ছে। তাদের মতে, এটি কোনো গোলাগুলি বা সরাসরি আক্রমণের মতো না হলেও, ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব হরণের চেষ্টা চলছে।
১৯৭৭ সালের তোরিজোস-কার্টার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে পানামা খাল পানামার হাতে তুলে দেওয়ার পর, সেখানে থাকা শেষ মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোও খালি করা হয়। পানামা খালের নিরপেক্ষতা চুক্তি অনুসারে, কোনো বিদেশি শক্তি তাদের জাতীয় ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনী, প্রতিরক্ষা কেন্দ্র বা সামরিক স্থাপনা রাখতে পারবে না।
বিরোধী দলের নেতা রিকার্ডো লম্বানা এই প্রসঙ্গে বলেন, “এটি একটি ছদ্মবেশী আগ্রাসন। কোনো গুলি না ছুড়েই, ক্ষমতার দাপট এবং হুমকির মাধ্যমে এই আগ্রাসন চালানো হচ্ছে।”
অন্যদিকে, পানামার জননিরাপত্তা মন্ত্রী ফ্রাঙ্ক অ্যাব্রেগো জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে, তবে এটি দেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী হবে না। তিনি আরও জানান, পানামা কোনো সামরিক ঘাঁটি গ্রহণ করবে না। তবে, এমওইউ-এর পূর্ণ পাঠে ফোর্ট শেরম্যান, রডম্যান নৌঘাঁটি এবং হাওয়ার্ড বিমানঘাঁটির ছবি ছিল, যেখানে ‘প্রশিক্ষণ’, ‘মানবিক কার্যক্রম’ এবং ‘মার্কিন সম্পত্তি স্থাপন’-এর জন্য স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
পানামা সরকার বলছে, এগুলো সামরিক ঘাঁটি নয় এবং চুক্তিটি অস্থায়ী। তবে বিরোধী দলগুলো এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। লম্বানার মতে, “যদি এমন কোনো স্থাপনা থাকে যা বিদেশি সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য এবং সেখানকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকে, যেখানে পানামাকে প্রবেশের আগে অনুমতি নিতে হয়, তবে সেটি অবশ্যই সামরিক ঘাঁটি।”
অনেকের মতে, মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর ফিরে আসা – এমনকি তথাকথিত ‘যৌথ অভিযানের’ নামে হলেও – ১৯৮৯ সালের ‘অপারেশন জাস্ট কজ’-এর স্মৃতি ফিরিয়ে আনবে, যেখানে মার্কিন সৈন্যরা হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছিল।
আরেকটি চুক্তি অনুসারে, খাল ব্যবহারের জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে ফি পরিশোধ করা হবে। এই বিশেষ সুবিধা নিরপেক্ষতা চুক্তির লঙ্ঘন হতে পারে এবং এর ফলে খালের ফি কমানোর জন্য আরও আলোচনা শুরু হতে পারে।
বৃহস্পতিবার, স্থানীয় এক আইনজীবী দেশটির প্রেসিডেন্ট জো রাউল মুলিনোর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, যিনি রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
সরকারের কূটনৈতিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। ট্রাম্প তার ২০ জানুয়ারির ভাষণে পানামা খাল পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার কথা জানানোর পর, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা মূলত মুলিনোর মাধ্যমেই হয়েছে এবং আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ গোপন রাখা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও’র সফরের সময় মুলিনো জানান, বৈঠকটি ‘খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ’ ছিল এবং খাল হুমকির মুখে নেই। তবে, রুবিও পরে বলেন, খালের পরিস্থিতি ‘অগ্রহণযোগ্য’। ট্রাম্পও খাল পুনরুদ্ধারের জন্য চাপ দিতে থাকেন।
সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে, হেগসেথের সঙ্গে মুলিনোর বৈঠকের বিষয়ে দুটি ভিন্ন বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। পানামার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হেগসেথ খালের উপর পানামার ‘অবিচ্ছেদ্য সার্বভৌমত্ব’ স্বীকার করেছেন, তবে প্রতিরক্ষাসচিবের বিবৃতিতে এই শব্দগুলো ছিল না। এমনকি হেগসেথ বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে পানামার মালিকানা স্বীকার করতেও রাজি হননি। পানামার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র যৌথ বিবৃতি থেকে এই শব্দগুলো বাদ দিয়েছে।
এছাড়াও, মুলিনো অন্যান্য দেশ, যেমন কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে আলোচনা এড়িয়ে গেছেন, যা আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারতো।
বৃহস্পতিবার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর স্থানীয় শাখা এক্সে (X) মুলিনোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন “ঘটনার বিস্তারিত, চলমান চুক্তি এবং তিনি যে চাপ অনুভব করছেন সে সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করেন। আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি এই হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন।”
পানামার প্রেসিডেন্ট মুলিনো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় খাল নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা ছাড়াই ছাড় দেওয়ায় সমালোচিত হচ্ছেন। জনমত জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ পানামাবাসী তার সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট। কূটনৈতিক সংকটের পাশাপাশি তিনি একটি বিতর্কিত সামাজিক নিরাপত্তা সংস্কার পাস করেছেন এবং পরিবেশবাদীদের ক্ষুব্ধ করেছেন। এছাড়াও, তিনি এমন একটি তাম্রখনি নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন যা ২০২৩ সালে স্থানীয় প্রতিবাদের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মুলিনোর দলের অনেক সংসদ সদস্য তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক রিকার্ডো মার্টিনেলির প্রতি অনুগত, যিনি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে নিকারাগুয়ার দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছেন।
শনিবার মার্কিন নীতি এবং সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সম্ভাবনা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান