ট্রাম্পের শুল্ক: চীনের পণ্য আমদানিতে ধ্বংসের সুর!

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের তৈরি পণ্যের উপর ট্রাম্পের শুল্ক: ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেক মার্কিন ব্যবসায়ী। এই সিদ্ধান্তের ফলে একদিকে যেমন পণ্যের দাম বাড়ছে, তেমনি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়েও।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, তাদের ব্যবসার ‘শেষ দিন’ এসে গেছে।

শিকাগোর একটি শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘লার্নিং রিসোর্সেস’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিক ওল্ডেনবার্গ জানান, চীনের উপর ট্রাম্পের প্রথমে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরেই তারা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

তিনি হিসাব কষেছিলেন যে, পণ্যের সামান্য দাম বাড়িয়ে তারা ৪০ শতাংশ শুল্কও সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু ট্রাম্প এরপর শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫৪ শতাংশ করেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা শুল্ক বসালে, সেই বোঝা গিয়ে দাঁড়ায় ১৪৫ শতাংশে।

ওল্ডেনবার্গ হিসাব করে দেখেছেন, গত বছর তার কোম্পানির যেখানে ২৩ লাখ ডলার শুল্ক দিতে হয়েছিল, ২০২৫ সাল নাগাদ সেই অঙ্ক গিয়ে দাঁড়াবে ১০ কোটি ২0 লাখ ডলারে।

তিনি বলেন, “আমার যদি ১০ কোটি ডলার থাকত! সত্যি বলছি, এটা একেবারে শেষের মতো লাগছে।”

চীনের সস্তা পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা।

আসলে, গত চার দশক ধরে, বিশেষ করে চীন ২০0১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেওয়ার পর থেকেই, আমেরিকার মানুষজন দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র—স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ক্রিসমাসের সাজসজ্জা—সবকিছুই চীনের কারখানা থেকে আসা পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

যদিও বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ—যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার কারণে, গত এক দশকে মেক্সিকো ও কানাডা চীনের জায়গা নিয়েছে।

বর্তমানে চীন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম পণ্য সরবরাহকারী দেশ।

দেশটির উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে ৯৭ শতাংশ বেবি ক্যারেজ, ৯৬ শতাংশ কৃত্রিম ফুল ও ছাতা, ৯৫ শতাংশ আতশবাজি, ৯৩ শতাংশ শিশুদের রঙিন বই এবং ৯০ শতাংশ চিরুনি আসে চীন থেকে।

আমেরিকান কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে চীনের হাজার হাজার কারখানার উপর নির্ভরশীল সাপ্লাই চেইন তৈরি করেছে।

কম শুল্কের কারণে এই ব্যবস্থা সহজ ছিল।

এমনকি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও, চীন থেকে আসা পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের গড় শুল্ক ছিল মাত্র ৩ শতাংশের সামান্য বেশি।

মিলওয়াকির ‘এবিসি গ্রুপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা জো জার্কেন বলেন, “আমেরিকার ভোক্তারা চীনকে তৈরি করেছে। আমেরিকান ক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলো সস্তা দামের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।”

দাম বাড়ছে, কমছে ব্যবসার গতি।

ট্রাম্প এখন উৎপাদনকারীদের আমেরিকায় ফেরার আহ্বান জানাচ্ছেন এবং এর জন্য আমদানি কারকদের উপর শুল্কের খড়গ চালাচ্ছেন।

ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেভিড ফ্রেঞ্চ বলেন, “এই ধরনের শুল্কের ফল অনেক দিক থেকে ধ্বংসাত্মক হতে পারে।”

ইয়েল ইউনিভার্সিটি বাজেট ল্যাব-এর হিসাব অনুযায়ী, ট্রাম্পের নেওয়া শুল্কের কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশ কমতে পারে।

এই শুল্কের কারণে জিনিসপত্রের দামও বাড়তে পারে।

মিশিগান ইউনিভার্সিটির এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকানরা দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি ৪.৪ শতাংশে পৌঁছানোর আশা করছে, যা গত মাসের তুলনায় বেশি।

আগে ‘মর্গান স্ট্যানলি এশিয়া’-র চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে ইয়েল ল স্কুল-এর ‘চায়না সেন্টার’-এর সঙ্গে যুক্ত স্টিফেন রৌচ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।

ভোক্তারাও এটা বুঝতে পারছেন।”

অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা।

ট্রাম্পের শুল্কের পরিমাণ যেমন ব্যবসায়ীদের উদ্বেগে ফেলেছে, তেমনই তারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন শুল্ক আরোপের গতি এবং এর অনিশ্চয়তা দেখে।

উদাহরণস্বরূপ, খেলনা প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘এমজিএ এন্টারটেইনমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা আইজ্যাক লারিয়ান জানান, তার কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের ৬৫ শতাংশ আসে চীন থেকে।

তিনি এই বছর এই হার ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।

লারিয়ান আরও জানান, তার কোম্পানি ভারত, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায়ও পণ্য তৈরি করে।

কিন্তু ট্রাম্প সেই দেশগুলোর উপরও শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন।

লারিয়ানের মতে, ‘ব্র্যাটজ’ পুতুলের দাম ১৫ ডলার থেকে বেড়ে ৪০ ডলারে এবং ‘এলওএল’ পুতুলের দাম দ্বিগুণ হয়ে ২০ ডলারে পৌঁছতে পারে।

এমনকি ‘লিটল টাইকস’ ব্র্যান্ডের খেলনার দামও বাড়তে পারে, যা ওহাইওতে তৈরি হয়।

ক্যালিফোর্নিয়ার ‘দ্য এজ ডেস্ক’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও মার্ক রোজেনবার্গ ১০০০ ডলার দামের কিছু আরামদায়ক চেয়ার তৈরির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন।

তিনি আগামী মাস থেকে চীনে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করেছিলেন।

কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কের কারণে তিনি এখন উৎপাদন স্থগিত রেখেছেন।

রোজেনবার্গ জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে জার্মানি এবং ইতালির মতো বাজারে তার চেয়ার বিক্রি করার কথা ভাবছেন, যেখানে ট্রাম্পের এই বিশাল শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে না।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন।

কারণ, বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রেও সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।

পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী শিল্পে এর প্রভাব পড়তে পারে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *