শিশুদের মনে ঢুকে যাওয়া ভয়ঙ্কর অনলাইন জগৎ: আতঙ্কের কারণ!

অনলাইন জগতে চরমপন্থীদের আগ্রাসন: কিশোর মনে বিভীষিকা, বাড়ছে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি।

বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিস্তারের সাথে সাথে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে জঙ্গি মানসিকতা তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই কাজটি এখন অনেক সহজে ও গোপনে করা যাচ্ছে।

বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পর্নোগ্রাফি, নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং চরম সহিংসতার ভিডিও’র মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মগজ ধোলাই করছে এবং তাদের জঙ্গি কার্যক্রমের দিকে আকৃষ্ট করছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সে ১২ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করার পর তার মা জানতে পারেন, ছেলেটি অনলাইনে নৃশংস ভিডিও দেখে কীভাবে মানুষ মারতে হয়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এমনকি, অভিযুক্ত কিশোরের ডিভাইসে বোমা তৈরির কৌশল সংক্রান্ত ভিডিও’ও পাওয়া গেছে।

ওই কিশোরের আইনজীবী জানিয়েছেন, প্রথমে ছেলেটি অনলাইনে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারত। এরপর, অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সে ক্রমশ জঙ্গিগোষ্ঠীর তৈরি করা সহিংস কনটেন্টের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

ফরাসি প্রসিকিউটর পল-এডওয়ার্ড ল্যালোয়া জানিয়েছেন, ওই কিশোরের মধ্যে চরমপন্থি মানসিকতা তৈরি করতে কয়েক বছর লেগেছে। তার মতে, ছেলেটিকে যদি সময় মতো থামানো না যেত, তবে সে হয়তো সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নিতো।

শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাস দমন বিভাগগুলো এখন নতুন প্রজন্মের সন্ত্রাসীদের নিয়ে কাজ করছে।

এদের বেশিরভাগই অল্পবয়সী এবং অনলাইনে সহিংসতার শিকার। অনেক ক্ষেত্রে, তারা পুলিশের নজরে আসে, যখন তারা কোনো সন্ত্রাসী হামলা ঘটানোর প্রস্তুতি নেয়।

ফ্রান্সের সন্ত্রাসবিরোধী প্রসিকিউটর, অলিভিয়ের খ্রিস্টেন জানিয়েছেন, ২০২২ সালে সন্ত্রাস-সংশ্লিষ্ট অভিযোগে মাত্র দুইজন কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১৫ তে দাঁড়ায় এবং গত বছর তা ১৯ জনে পৌঁছেছে।

তিনি আরও বলেন, “আগে এমন ঘটনা শোনা যেত না, যেখানে ১৫ বছর বয়সের কিশোর সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের প্রচারের ক্ষেত্রে কতটা সফল।”

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নিরাপত্তা সংস্থাগুলিও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে, “উগ্রপন্থী কিশোররা প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই সন্ত্রাসী হুমকি তৈরি করতে পারে।”

জার্মানিতেও কিশোরদের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যা কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে নজরদারি করছে।

অস্ট্রিয়ায়, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৯, ১৮ এবং ১৭ বছর বয়সী কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে একটি কনসার্টে হামলার পরিকল্পনা করার অভিযোগ রয়েছে।

বেলজিয়ামের ভিএসএসই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সন্দেহভাজনদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ছিল কিশোর। তাদের মধ্যে ১৩ বছর বয়সীও ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন শিশুকে অনলাইনে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করতে কয়েক মাস সময় লাগে। কিশোর-কিশোরীরা খুব দ্রুত তাদের অনলাইন কার্যক্রম গোপন করতে পারে এবং অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে যেতে পারে।

আশ্চর্যজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব কিশোর-কিশোরীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিল। তাদের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়নি।

তবে, তাদের ডিভাইসে নৃশংস ভিডিও, বোমা তৈরির কৌশল এবং জিহাদি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের মধ্যে জঙ্গি মানসিকতা তৈরির পেছনে পর্নোগ্রাফি এবং সহিংসতার প্রতি আকর্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এরপর, তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহিংস ভিডিওর প্রতি আকৃষ্ট হয়।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়, সরকার, অভিভাবক এবং সমাজের সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। শিশুদের অনলাইন কার্যকলাপের উপর নজরদারি বাড়ানো, তাদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ তৈরি করা এবং জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *