শিশুদের ঘুম: শান্ত ঘরে নয়, ওয়াশিং মেশিনের পাশে ঘুম পাড়ানোর পরামর্শ!

শিশুদের ঘুম নিয়ে নতুন কিছু কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এতদিন ধারণা ছিল, শিশুদের শান্ত ও অন্ধকার ঘরে ঘুমানো উচিত। কিন্তু সম্প্রতি, ঘুমের বিষয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা।

তাদের মতে, শিশুদের দিনের বেলা হালকা আলো ও স্বাভাবিক শব্দ যুক্ত পরিবেশে ঘুমানো ভালো। ওয়াশিং মেশিনের শব্দ অথবা অন্য কোনো পরিচিত শব্দ এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

ঘুম বিশেষজ্ঞ এবং ডারহাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেলেন বল মনে করেন, দিনের বেলায় শিশুদের লম্বা সময় ধরে ঘুমাতে দেওয়া ‘মিনি নাইট টাইমের’ মতো। যা তাদের রাতের ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করতে পারে।

তিনি আরও যোগ করেন, অভিভাবকদের উচিত শিশুদের তাদের ঘুমের চাহিদা অনুযায়ী, স্বাভাবিকভাবে হালকা আলোযুক্ত ঘরে ঘুমাতে দেওয়া। এর ফলে শিশুরা পর্যাপ্ত ঘুম হলে নিজেরাই জেগে উঠবে।

অধ্যাপক বল, যিনি ২০১৮ সালে প্যারেন্ট ও শিশুদের ঘুম বিষয়ক গবেষণার জন্য কুইন’স অ্যানিভার্সারি পুরস্কার জিতেছিলেন, বলেন, “শিশুদের ঘুমের সময় নিয়ন্ত্রণের যে প্রবণতা, তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা—এই বিষয়গুলো বাড়ছে।

কারণ এখন বাজারে ঘুমের প্রশিক্ষক, বেবি স্লিপ মনিটর এবং ‘ওয়েক উইন্ডো’ (ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়) বিষয়ক নানা অ্যাপ পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলো শিশুদের কখন ঘুম প্রয়োজন, তা হিসাব করে বলে।”

শিশুদের ঘুমের ধরন নিয়ে অধ্যাপক বলেন, “আমাদের মতো শিশুদেরও ঘুমের জন্য ‘স্লিপ প্রেসার’ বা ঘুমের চাপ তৈরি করতে হয়। দিনের বেলা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও শক্তি খরচের মাধ্যমে তারা ক্লান্ত হয়, এবং এর ফলে তাদের ঘুম আসে।

তাই তারা বিভিন্ন সময়ে ঘুমায়, যা নির্ভর করে তারা সারাদিন কতটা সক্রিয় ছিল তার ওপর। যেমন—শিশুটি যদি বাইরে হেঁটে আসে, তাহলে তার ঘুম তাড়াতাড়ি আসতে পারে।

আবার ঘরের মধ্যে থাকলে ঘুমের সময় ভিন্ন হতে পারে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “অনেক অভিভাবক চান, তাদের সন্তান একটি নির্দিষ্ট সময়ে, শান্ত ও অন্ধকার ঘরে ঘুমাক। যাতে তারা নিজেদের কাজ করতে পারেন।

কিন্তু শিশুদের জন্য এটা সবসময় সঠিক নয়। কারণ দিনের বেলার এই ঘুম তাদের রাতের ঘুম নষ্ট করতে পারে।”

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা বিষয়ক সংস্থা, এনএইচএস (NHS)-এর পরামর্শ হলো, “শিশুদের শুরু থেকেই দিন ও রাতের ঘুমের মধ্যে পার্থক্য শেখানো উচিত। দিনের বেলায় জানালা খোলা রাখা, খেলাধুলা করা যেতে পারে।

ঘুমের সময় স্বাভাবিক শব্দ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক শিশুর নিজস্ব ঘুমের ধরন থাকে এবং অন্যদের থেকে তা আলাদা হতে পারে।”

শিশুদের রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন—ক্ষুধা, দাঁত ওঠা, নতুন কোনো দক্ষতা অর্জন করা অথবা একা থাকার ভয় থেকে তারা জেগে উঠতে পারে।

ঘুমের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের রাতে জেগে উঠলে তাদের কাছে না গিয়ে, নিজেরাই শান্ত হতে উৎসাহিত করা হয়। তবে অধ্যাপক বল এই ধরনের প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করেন।

তার মতে, অতীতের ধারণা থেকে অভিভাবকদের মধ্যে শিশুদের ঘুম নিয়ে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, তাদের দেখাতে হবে, তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং শিশুদের ঘুমের রুটিন তৈরি করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুমের ঘাটতি পূরণের জন্য অভিভাবকদের আগে ঘুমাতে যাওয়া উচিত। কারণ শিশুরা রাতের শুরুতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ঘুমায়।

এছাড়াও, বড় শিশুদের ঘুমানোর সময় সামান্য পরিবর্তন করে, রাতে তারা যখন প্রথম জেগে ওঠে, সেই সময়টা পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

শিশুদের ঘুম পাড়ানোর প্রচলিত একটি উপায় হলো, তাদের ক্লান্তির লক্ষণগুলো নজরে রাখা। যেমন—চোখ কচলাতে শুরু করা, কান টানা অথবা হাই তোলা।

কিন্তু অধ্যাপক বল বলেন, “ক্লান্তির এই লক্ষণগুলো আসলে একঘেয়েমি অথবা অন্য কিছু করার প্রয়োজনীয়তাও হতে পারে। এমনকি শিশু ক্লান্ত হলেও, সবসময় ঘুমের জন্য প্রস্তুত নাও হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা হয়তো অনেক চেষ্টা করেও শিশুকে ঘুম পাড়াতে ব্যর্থ হন।”

শিশুদের ঘুমের সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, বর্তমানে বেবি স্লিপ কনসালটেন্ট বা ঘুম বিষয়ক পরামর্শকের সংখ্যা বাড়ছে।

যারা শিশুদের ঘুমের সময় নির্ধারণ করেন। কিছু ক্ষেত্রে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদের প্রভাব দেখা যায়।

তবে শিশুদের ঘুমের সময় নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে একজন ঘুম পরামর্শক, আন্ড্রিয়া গ্রেস বলেন, “শিশুদের কখন ঘুম প্রয়োজন, তা বুঝতে ‘ওয়েক উইন্ডো’ অভিভাবকদের সাহায্য করতে পারে।

এই সময় অনুযায়ী ঘুমের সময় নির্ধারণ করলে শিশুদের অতিরিক্ত ক্লান্ত হওয়া থেকে বাঁচানো যায়, যা তাদের ঘুমের জন্য সহায়ক।”

কিং’স কলেজ লন্ডনের শিশু ঘুম বিষয়ক বিভাগের প্রধান এবং আন্তর্জাতিক পেডিয়াট্রিক স্লিপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক পল গ্রিংরাস বলেন, “চিকিৎসা এবং মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঘুমের ক্ষেত্রে এক নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়।

বিভিন্ন পরিবারের জন্য ভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োজন হতে পারে। তবে, শিশুদের জন্মের প্রথম তিন মাসে ঘুমের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম তৈরি করা উচিত নয়, কারণ এটি তাদের স্বাভাবিক ঘুম-জাগরণ চক্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং তাদের খাওয়াদাওয়াতেও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।”

অধ্যাপক গ্রিংরাস আরও যোগ করেন, “সব পরিবারই আলাদা এবং অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে, তারা হয়তো শিশুদের একই সময়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত করতে চাইবেন।

কারণ দিনের এই ছন্দ তাদের জন্য সহায়ক।”

তিনি আরও জানান, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের রাতে একা রেখে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলে, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ে।

তবে, ঘুমের জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে শিশুদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে অন্যান্য গবেষণাগুলোতে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। তাই এই বিষয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের বেবি স্লিপ কনসালটেন্টদের যোগ্যতা যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ এই পেশাটি এখনও নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।

তথ্যসূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *