শিরোনাম: সপ্তাহে আট গ্লাস বা তার বেশি মদ্যপান স্মৃতিভ্রংশতার ঝুঁকি বাড়ায়: গবেষণা
নতুন একটি গবেষণায় অ্যালকোহল পানের সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশতা বা ডিমেনশিয়ার (Dementia) সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। ব্রাজিলের সাও পাওলো মেডিকেল স্কুলের গবেষকদের করা এই গবেষণাটি সম্প্রতি ‘নিউরোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে আট গ্লাস বা তার বেশি মদ্যপান করেন, তাদের মস্তিষ্কের কিছু অংশে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই ক্ষতগুলো আলঝেইমার্সের (Alzheimer’s) মতো রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মস্তিষ্কের এই ক্ষতগুলোকে ‘হাইলাইন আর্টেরিওলোস্ক্লেরোসিস’ বলা হয়। এর ফলে রক্তনালী সরু হয়ে যায়, যা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে।
গবেষণাটির প্রধান লেখক আলবার্তো ফার্নান্দো ওলিভেইরা জাস্টো বলেছেন, “অতিরিক্ত মদ্যপান একটি বড় বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য বিষয়ক জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখেছি, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালকোহল কীভাবে মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে। আমাদের গবেষণা দেখাচ্ছে, অতিরিক্ত মদ্যপান মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর, যা স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে।”
গবেষণায় ১,৭৮১ জন মানুষের মস্তিষ্কের ময়নাতদন্তের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৭৫ বছর। গবেষকরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মদ্যপানের পরিমাণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।
এরপর তাদের মস্তিষ্কের আঘাতগুলো পরীক্ষা করা হয়, যেমন – ক্ষত এবং ‘টাউ ট্যাঙ্গেলস’। টাউ ট্যাঙ্গেলস হলো আলঝেইমার্স রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।
জাস্টো বলেন, “আমরা দেখেছি, অতিরিক্ত মদ্যপান মস্তিষ্কে আঘাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এর ফলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে, যা স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা কোনো দিন মদ্যপান করেননি, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের মস্তিষ্কে আঘাত ছিল। হালকা মদ্যপানকারীদের মধ্যে এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ।
এছাড়া, অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ এবং যারা আগে অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন, তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া গেছে।
অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের মধ্যে ‘টাউ ট্যাঙ্গেলস’-এর উপস্থিতিও বেশি ছিল। অন্য গ্রুপের তুলনায় তাদের মধ্যে এই ঝুঁকির পরিমাণ ছিল ৪১ শতাংশ বেশি।
প্রাক্তন অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা গেছে, যেখানে ৩১ শতাংশের মধ্যে এই ঝুঁকি ছিল।
জাস্টো বলেছেন, “এই প্রভাবগুলো বোঝা জনস্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, অতিরিক্ত মদ্যপান কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রাক্তন অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের মস্তিষ্কের আকার ছোট ছিল এবং তাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতাও দুর্বল ছিল। তবে, বর্তমানে যারা মদ্যপান করেন, তাদের মধ্যে এই ধরনের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। অতিরিক্ত মদ্যপানকারীরা অন্যদের চেয়ে গড়ে ১৩ বছর আগে মারা যান।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য বিষয়ক নির্দেশিকা অনুযায়ী, ২১ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের প্রতিদিন দুইটির বেশি এবং ২১ বছরের বেশি বয়সী নারীদের প্রতিদিন একটির বেশি মদ্যপান করা উচিত নয়।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এবং সহযোগী অধ্যাপক ড. লিনা ওয়েন, যিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না, তিনি এই গবেষণার ফলাফলকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তার মতে, এর মাধ্যমে মানুষের অ্যালকোহল সেবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবা উচিত।
ড. ওয়েন আরও বলেন, “এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, প্রাক্তন অতিরিক্ত মদ্যপানকারীদের মধ্যেও ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও মদ্যপান বন্ধ করার মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটা মনে রাখতে হবে যে, এই গবেষণাটি কিছু সম্পর্ক দেখিয়েছে, তবে এটি সরাসরি কারণ এবং প্রভাবের প্রমাণ নয়। এছাড়াও, গবেষণায় অ্যালকোহল সেবনের সময়কাল পরিমাপ করা হয়নি। যারা নিয়মিত অল্প পরিমাণে পান করেন এবং যারা অনিয়মিতভাবে বেশি পান করেন, তাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি।”
ড. ওয়েনের মতে, অ্যালকোহল সেবনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। কারণ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে বিতর্ক করছেন।
তবে, যারা মদ্যপান করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পান করার ক্ষেত্রে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা।
তথ্য সূত্র: পিপলস