মহাকাশের চৌকাঠে: ব্লু অরিজিনের যাত্রীদল, মহাকাশ কি সত্যিই শুরু?
মহাকাশ ভ্রমণের দৌড়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল ব্লু অরিজিন। সম্প্রতি, তারা ছয় জন মহিলা যাত্রী নিয়ে একটি বিশেষ অভিযান সম্পন্ন করেছে, যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল কার্মান লাইন (Kármán line) অতিক্রম করা।
এই কার্মান লাইনকে অনেক সময় মহাকাশের শুরু হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মহাকাশ ঠিক কোথায় শুরু হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আজও রয়েছে নানান মত।
ব্লু অরিজিনের এই অভিযানে ছিলেন বিখ্যাত গায়িকা কেটি পেরি এবং সাংবাদিক গেল কিংয়ের মতো ব্যক্তিত্ব। এই মিশনটি প্রায় ১০ মিনিটের ছিল, যেখানে যাত্রীরা ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি উচ্চতায় পৌঁছে কয়েক মিনিটের জন্য ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
এই ভ্রমণের মাধ্যমেই তারা কার্মান লাইনের সীমানা পেরিয়ে যান। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই উচ্চতায় পৌঁছানোই কি মহাকাশে প্রবেশ?
আসলে, মহাকাশের সংজ্ঞা দেওয়াটা বেশ কঠিন। বিভিন্ন সংস্থা এই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করে।
কেউ কেউ মনে করেন, যেখানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এতটাই হালকা হয়ে যায় যে বিমানের পক্ষে ওড়া সম্ভব নয়, সেটাই মহাকাশ। আবার কারো মতে, পৃথিবীর চারপাশে উপগ্রহগুলি যে উচ্চতায় ঘুরতে পারে, সেটাই মহাকাশের শুরু।
কার্মান লাইন (Kármán line), যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত, মহাকাশের একটি বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা। ব্লু অরিজিন তাদের ফ্লাইটের মাধ্যমে এই সীমারেখা অতিক্রম করে।
অন্যদিকে, তাদের প্রধান প্রতিযোগী ভার্জিন গ্যালাকটিকের ফ্লাইটগুলি সাধারণত ৮৮.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যায়। যদিও এই উচ্চতাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ৮১ কিলোমিটারের (৫০ মাইল) বেশি, যা মহাকাশের সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে, মহাকাশযাত্রী (astronaut) হওয়ার সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার একসময় সামরিক ও নাসা পাইলটদের জন্য ৮১ কিলোমিটারের উপরে ওঠা একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করেছিল।
পরবর্তীতে, ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) বেসরকারি খাতের অভিযাত্রীদেরও বাণিজ্যিক মহাকাশচারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে, এই প্রোগ্রামটি এখন আর চালু নেই।
স্পেসএক্স তাদের নিজস্ব ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলে ভ্রমণকারী অ-সরকারি যাত্রীদের জন্য সিলভার উইংস প্রদান করে।
প্রকৃতপক্ষে, কে মহাকাশচারী এবং কে নয়, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব মূলত রেকর্ড রক্ষকদের। প্রাক্তন নাসা নভোচারী টেরি ভার্টস মনে করেন, “যে কেউ রকেটে চড়ে ভ্রমণ করেন, তিনি কিছু একটা অর্জন করেন।”
ওজনহীনতা (weightlessness)-এর অভিজ্ঞতা লাভের বিষয়টি উচ্চতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। ব্লু অরিজিনের ক্যাপসুল যখন সর্বোচ্চ বিন্দুতে (apogee) পৌঁছায়, তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তখনও কাজ করে।
কিন্তু রকেট এবং ক্যাপসুলের বেগ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে প্রতিহত করে, যার ফলে যাত্রীরা কয়েক মিনিটের জন্য ওজনহীনতা অনুভব করেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা অবশ্য মাসের পর মাস ধরে ওজনহীন থাকেন, কারণ তারা পৃথিবীর কক্ষপথে (orbit) পরিভ্রমণ করেন।
মহাকাশের সংজ্ঞা নির্ধারণে বিভিন্ন গবেষণা এখনও চলছে। হাঙ্গেরীয়-মার্কিন প্রকৌশলী এবং নাসা’র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর ফন কার্মান, প্রথম দিকে মহাকাশের সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে তাঁর দেওয়া সংজ্ঞাগুলোও ছিল নির্ভুল নয়। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, “বায়ুমণ্ডল গতিশীল এবং ঘনত্বের পরিবর্তনশীলতার কারণে, কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করা কঠিন।” তাই কার্মান লাইনের উচ্চতা ৮৪ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে।
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থা ফেডারেশন অ্যারোনটিক ইন্টারন্যাশনাল (FAI) এই কার্মান লাইনকে ১০০ কিলোমিটার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তবে, অন্যান্য বিজ্ঞানী ও মহাকাশ শিল্পের বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত পোষণ করেন।
রেডওয়্যার স্পেসের মহাকাশ মিশন বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পেন্স ওয়াইজ মনে করেন, ৮৮ কিলোমিটারের কাছাকাছি একটি উচ্চতা আরও সঠিক। তাঁর মতে, এই সংজ্ঞাটি মহাকাশ থেকে ফিরে আসা বিভিন্ন রকেট বডির আচরণ থেকে এসেছে, যা বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে পৃথিবীর দিকে নেমে আসে।
সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, প্রযুক্তি এবং মহাকাশ ভ্রমণের অগ্রগতির সাথে সাথে এই বিষয়ে আরও নতুনত্ব আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তথ্য সূত্র: CNN