পুরুষের বন্ধুত্ব: কোথায় সমস্যা, কিভাবে সমাধান?

পুরুষদের বন্ধুত্বের পথে বাধা ও উত্তরণের উপায়

bন্ধুত্ব মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নারীদের বন্ধুত্বের গুরুত্ব নিয়ে অনেক কথা হয়, আলোচনা হয়। কিন্তু পুরুষদের বন্ধুত্ব? গবেষণা বলছে, অর্ধেকের কম সংখ্যক পুরুষ তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট। কৈশোরের শেষ ভাগ থেকে যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষদের বন্ধুত্বের গভীরতা কমতে শুরু করে।

নর্মান বংশোদ্ভূত কিম ইভেন্সেন, যিনি পুরুষদের বন্ধুত্বের উন্নতিতে কাজ করা একটি অলাভজনক সংস্থা ‘ব্রাদার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নিজের পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের ফাঁকগুলো বুঝতে পারেন ২৫ বছর বয়সে। তিনি বলেন, “পুরুষ হিসেবে আমাদের কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। যেমন ছেলেরা কাঁদে না, দুর্বলতা প্রকাশ করে না, এমনকি পরস্পরের খুব কাছাকাছিও আসে না।”

ইভেন্সেন খেয়াল করেন, বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর সময় কাটানোটা নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে—যেমন, একসঙ্গে বসে বিয়ার খাওয়া অথবা ব্যায়াম করা। তিনি মনে করেন, বন্ধুত্বকে আরও গভীর কিছু হতে হবে, কারণ সমাজের চোখে পুরুষদের বন্ধুত্বের যে ধারণা, সেই অনুযায়ী চললে তাঁদের জীবনে গভীর সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

নিজের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে এবং অন্যদের সাহায্য করার জন্য ইভেন্সেন পুরুষদের বন্ধুত্বের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ—যেমন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নিওবি ওয়ে-এর পরামর্শ নেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘ব্রাদার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ছিল, যা পরে একটি পূর্ণকালীন পেশায় রূপ নেয়।

পুরুষদের বন্ধুত্ব নিয়ে ইভেন্সেন দুটি বই লিখেছেন—‘ব্রাদার্স: এভরি ম্যান নিডস স্ট্রং, অথেন্টিক ফ্রেন্ডশিপস’ এবং ‘দ্য রিয়েল ব্রো কোড: দ্য এসেন্সিয়াল গাইড ফর ডুডস অন হাউ টু বি এ ব্রো’। তিনি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কেনিয়া এবং আরও অনেক দেশে পুরুষদের বন্ধুত্ব ও পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলেছেন।

ইভেন্সেন তাঁর আলোচনাগুলোতে পুরুষদের জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা কেমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক চান এবং বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সেরা মুহূর্তগুলো কী ছিল। তিনি বলেন, “আমি সত্যিই পুরুষদের আরও ঘনিষ্ঠ এবং গভীর বন্ধুত্ব তৈরি করতে উৎসাহিত করতে চাই। এমন কথা বলতেও অনেকে হাসাহাসি করে।”

পুরুষদের বন্ধুত্বের পথে কিছু সাধারণ বাধা রয়েছে এবং সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যায়, সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা হলো।

প্রথম বাধা: বন্ধুত্বের বিষয়ে কথা বলতে অনীহা

পুরুষদের গভীর বন্ধুত্বের পথে প্রথম বাধা হলো, বন্ধুত্বের বিষয়ে কথা বলতে চাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা বোধ করা। ইভেন্সেন বলেন, “ড. নিওবি ওয়ে-এর কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছি, কিশোর বয়সের অনেক ছেলেই তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রতি গভীর আবেগ ও ভালোবাসার কথা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রকাশ করে। কিন্তু যখন সেই কথাগুলো অন্যদের সামনে বলতে হয়, তখন তারা হাসাহাসি করে এবং বিষয়টিকে অদ্ভুত বা মেয়েলি বলে উড়িয়ে দেয়।”

বন্ধুত্বের কথা বলতে গেলে হয়তো কিছুটা অস্বস্তি হতে পারে। তবে বিষয়টিকে এভাবে দেখা যেতে পারে—যদি পেশি তৈরি করতে চান, তাহলে ব্যায়াম করতে হবে। ভালো বন্ধুত্বের জন্যেও চেষ্টা করতে হয়।

ইভেন্সেন পরামর্শ দেন, “বিষয়টি নিয়ে কথা বলুন। বন্ধুদের জানান যে আপনি তাঁদের কতটা মূল্যায়ন করেন এবং এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর করতে চান।”

দ্বিতীয় বাধা: সমাজের ভুল ধারণা

পুরুষদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে সমাজের একটি ভুল ধারণা রয়েছে। ইভেন্সেন বলেন, “যদি পুরুষরা সমাজের বন্ধুত্বের ধারণাকে মেনে নেয়, তবে তাদের গভীর সম্পর্ক তৈরি হবে না। সাধারণভাবে, পুরুষদের বন্ধুত্বকে সহজ এবং আবেগগত ঝুঁকিহীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কম পরিচর্যা এবং সামান্য অঙ্গীকার—এটাই যেন দস্তুর।”

তবে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে হলে চেষ্টা করতে হবে। বন্ধুত্ব সম্পর্কের মতোই। এখানে দুজন মানুষেরই প্রয়োজন। বন্ধুদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে সময় কাটানোর পরিবর্তে, চেষ্টা করুন একা সময় কাটাতে। এতে একে অপরের প্রতি মনোযোগ দেওয়া যায় এবং গভীর সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হয়।

তৃতীয় বাধা: সংকীর্ণ পুরুষতান্ত্রিক ধারণা

পুরুষতান্ত্রিক ধারণা পুরুষদের বন্ধুত্বের উপর প্রভাব ফেলে। মনোবিজ্ঞানী ও পারিবারিক থেরাপিস্ট ড. রবার্ট গারফিল্ড তাঁর ‘ব্রেকিং দ্য মেইল কোড: আনলকিং দ্য পাওয়ার অফ ফ্রেন্ডশিপ’ বইয়ে লিখেছেন, অনেক পুরুষ একটি অলিখিত নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ থাকে যে তারা কেবল পুরুষালি আবেগ প্রকাশ করবে।

ইভেন্সেন বলেন, “পুরুষত্ব প্রমাণের জন্য অনেকে ভালোবাসার গভীরতা এড়িয়ে চলে। তাঁরা ভয় পায়, কেউ হয়তো তাঁদের গে (সমকামী) ভাববে। ঘনিষ্ঠ কথোপকথন, আন্তরিক উৎসাহ অথবা পিঠ চাপড়ানো—এগুলোও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। তাই অনেকে নিরাপদ থাকতে চায়।”

তিনি আরও বলেন, “ভালোবাসা এবং যৌনতাকে অনেক সময় গুলিয়ে ফেলা হয়। অজান্তেই আমরা ভালোবাসা এবং ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করি, যা পুরুষদের বন্ধুত্বের গভীরতাকে নষ্ট করে দেয়।”

চতুর্থ বাধা: সম্পর্কের ক্ষেত্রে একচেটিয়া ধারণা

যখন একজন পুরুষের বান্ধবী বা সঙ্গী আসে, তখন অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক কমে যায়। ইভেন্সেন বলেন, “এটা খুবই সাধারণ ঘটনা এবং আমরা এটাকে জীবনের একটা অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। আমাদের মনে হয়, গভীর সম্পর্কের সুযোগ থাকতে কেন আমরা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাব?”

রোমান্টিক সম্পর্ককে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি বন্ধুদেরও গুরুত্ব দিতে হবে। আপনার বন্ধু যদি কোনো মেয়ের জন্য আপনাকে এড়িয়ে চলে, তবে আপনার কেমন লাগবে? অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই। নিশ্চিত করুন, আপনার বান্ধবী যেন আপনার বন্ধুদের সম্পর্কে জানে, কারণ সে আপনার জীবনের একটি অংশ হতে চলেছে।

ইভেন্সেন আরও যোগ করেন, “আমাদের এমন ধারণা হওয়া উচিত নয় যে, আমাদের সমস্ত আবেগ এবং সম্পর্কের চাহিদা আমাদের সঙ্গীর কাছ থেকে পূরণ হবে। সিনেমায় এটা হয়তো রোমান্টিক শোনাতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে এটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়।”

বন্ধুত্ব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তাই বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাঁদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা এবং সম্পর্কের গভীরতা বজায় রাখা—পুরুষদের জন্য খুবই জরুরি।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *