শিরোনাম: খাবারের প্রতি ঘৃণা: বিবর্তন, সংস্কৃতি ও আমাদের স্বাদের রহস্য
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন কেন কারো ইলিশ মাছ এত প্রিয়, আবার কারো কাছে তা অসহ্য? খাবারের প্রতি আমাদের ভালো লাগা বা খারাপ লাগা – এর পেছনে লুকিয়ে আছে বিবর্তন, সংস্কৃতি আর আমাদের অভিজ্ঞতার এক জটিল খেলা।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে এই স্বাদের রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, খাদ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের রুচিবোধের জন্ম হয়েছে বহু বছর আগে, যখন আমাদের পূর্বপুরুষদের টিকে থাকার জন্য খাবার বাছাই করাটা ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন।
তিক্ত স্বাদের খাবার, যা সাধারণত বিষাক্ত পদার্থের ইঙ্গিত দেয়, তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা সম্ভবত তাই বিবর্তনের ফল। মিষ্টি স্বাদ, যা শক্তি যোগায়, তার প্রতি আকর্ষণও টিকে থাকার লড়াইয়ের অংশ।
তবে, আধুনিক যুগে যখন খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও গঠন বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, তখন এই পুরনো কৌশলগুলো সবসময় আমাদের সঠিক পথ দেখায় না।
প্রক্রিয়াজাত খাবার আমাদের খাদ্য তালিকার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। ফলে, সুস্বাদু কিন্তু পুষ্টিগুণ কম এমন খাবারের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বাড়ে, যা স্বাস্থ্যকর খাবারের থেকে আমাদের দূরে নিয়ে যায়।
তাহলে, আমাদের খাদ্য রুচিকে আর কী বিষয়গুলো প্রভাবিত করে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর পেছনে কাজ করে আমাদের শরীর, মস্তিষ্ক, পরিবেশ, বাবা-মা এবং সংস্কৃতি।
আমাদের শরীর যেমন বিষাক্ত উপাদান থেকে বাঁচতে চায়, তেমনি আমাদের মস্তিষ্কও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখে নেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শৈশবে মায়ের খাদ্যাভ্যাস শিশুর রুচিবোধ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মায়ের খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খাবার গ্রহণের ধরন দেখে শিশুরা তাদের পছন্দের বিষয়টি তৈরি করে।
এমনকি গর্ভবতী মায়ের খাদ্যাভ্যাসও শিশুর রুচিতে প্রভাব ফেলে।
খাবার গ্রহণের পরিবেশও এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
খাবার পরিবেশনের ধরন, শব্দের প্রভাব—এগুলো আমাদের মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ধারণা তৈরি করে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, খাবার খাওয়ার সময় গান শুনলে তা আমাদের স্বাদ গ্রহণের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে।
এছাড়া, ঘরের রং বা প্লেটের ডিজাইনও খাবারের স্বাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
খারাপ অভিজ্ঞতার কারণেও অনেক সময় কিছু খাবারের প্রতি আমাদের অনীহা তৈরি হয়।
কোনো খাবার খাওয়ার পর যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে সেই খাবারটি ভবিষ্যতে এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আমাদের মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি হয়, যার ফলে নির্দিষ্ট একটি খাবারের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি ঘৃণা জন্মায়।
তবে, আমাদের খাদ্যরুচি গঠনে শুধু পরিবেশই নয়, জিনগত প্রভাবও রয়েছে।
কিছু মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি ঘৃণা জন্মগতভাবে থাকতে পারে।
যেমন, অনেকের মধ্যে ধনে পাতার স্বাদ তেতো লাগার কারণ হলো একটি বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্য।
আবার, কিছু জিনের কারণে কেউ কেউ সাদা ওয়াইন, বেকন বা শিকোরি জাতীয় খাবার বেশি পছন্দ করে।
গর্ভাবস্থায় অনেক মহিলার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু খাবারের প্রতি তীব্র অনীহা দেখা যায়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীর তখন ভ্রূণের সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকর খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে চায়।
তবে, খাদ্য রুচি পরিবর্তনযোগ্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিয়মিত চেষ্টা করলে কোনো খাবারের প্রতি ভালো লাগা তৈরি করা সম্ভব।
কোনো খাবার অপছন্দ হলেও, সেটি পছন্দের তালিকায় আনতে হলে, সেই খাবারের সাথে ইতিবাচক কিছু বিষয় যুক্ত করতে হবে।
ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবারটি খেলে, মস্তিষ্কে সেটি ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করতে সাহায্য করে।
এছাড়া, বারবার সেই খাবারটি খাওয়ার মাধ্যমেও ভালো লাগা তৈরি করা যেতে পারে।
খাবার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং নতুন স্বাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা খুবই জরুরি।
খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্য আনতে পারলে, একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তেমনি খাবারের প্রতি আমাদের ভালো লাগাটাও বাড়ে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক