ইউরোপের বুকে, স্বপ্নের এক পথ: সাইকেলে রোমানিয়ার ‘ভিয়া ট্রান্সিলভানিকা’
ভ্রমণ ভালোবাসেন এমন মানুষের জন্য ইউরোপ যেন এক বিশাল ক্যানভাস। আর সেই ক্যানভাসে রোমানিয়ার ‘ভিয়া ট্রান্সিলভানিকা’ এক অসাধারণ চিত্রকর্ম। এটি কেবল একটি পথের নাম নয়, বরং প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া, সংস্কৃতিকে অনুভব করা এবং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার সাক্ষী হওয়ার এক দারুণ সুযোগ।
সম্প্রতি, সাইকেলে চড়ে এই পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো।
‘ভিয়া ট্রান্সিলভানিকা’ হলো রোমানিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত প্রায় ১,৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক পথ। এটিকে ‘প্রাচ্যের ক্যামিনো’ও বলা হয়, যা ইউক্রেন সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে ড্রবেটা-টার্নু সেভেরিন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পথ তৈরি হয়েছে প্রাচীন বাণিজ্য পথ ও গবাদি পশু পরিবহনের পথ ধরে।
পরিবেশবিদ আলিন উসেরিউ এবং তার ভাই টিবেরিউ-এর হাত ধরে এই পথের সৃষ্টি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, স্থানীয় মাফিয়াদের বাধা এবং কার্পেথিয়ান পর্বতমালার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাকে জয় করে তারা এই পথ তৈরি করেছেন। এটি যেন মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সাইকেল চালানোর এই ভ্রমণে, প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সবুজ পাহাড়, ঘন বনভূমি, আর মাঝে মাঝে দেখা মিলছিল ঐতিহ্যবাহী গ্রামগুলির। এখানকার ১৬ শতকের মঠগুলি, যা বাইরের দিকে আঁকা চিত্রকর্মের জন্য বিখ্যাত, সেই সময়ের সংস্কৃতি ও শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।
স্থানীয় গাইড সার্গিউ জানিয়েছিলেন, “এগুলো ছিল নিরক্ষরদের জন্য বাইবেল।”
পথের কোথাও কোথাও, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে, সাইকেল চালানো বেশ কঠিন ছিল। সেক্ষেত্রে হাইকিং বা পায়ে হেঁটে পথ চলার ব্যবস্থা ছিল।
বনের ভেজা মাটি, পাইন গাছের গন্ধ, আর দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন দৃশ্য—সব মিলিয়ে এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মাঝে মাঝে দেখা মিলছিল ভেড়ার পালের, যাদের পাহারা দিচ্ছিল বিশাল আকারের কুকুরের দল। সার্গিউ সতর্ক করে বলেছিলেন, “পাল থেকে আলাদা হলে তারা আক্রমণ করতে পারে।”
ভ্রমণের সময়, স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাবারের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। রাতের বেলা স্থানীয় গেস্ট হাউসে (যেমন লা মোরা) থাকার ব্যবস্থা ছিল, যেখানে কাঠের কারুকার্য করা আসবাবপত্র ও আল্পাইন ঘরানার ছোঁয়া ছিল। রাতের খাবারে ছিল ঐতিহ্যবাহী ‘গ্যালুস্ট’ স্যুপ, যা মাংস ও সবজির সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
এছাড়াও, চিকেন পাপরিকাস ও স্থানীয়ভাবে তৈরি পনিরযুক্ত বেকড পোলেন্টা-র স্বাদ ছিল অতুলনীয়।
এই পথের অন্যতম লক্ষ্য হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে উন্নত করা। পর্যটকদের আনাগোনা তাদের রুটি-রুজি জোগাতে সাহায্য করে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পথটি চালু হওয়ার পর থেকে তাদের অতিথি আসার সংখ্যা ৬ গুণ বেড়েছে।
যারা একটু ভিন্ন ধরনের ভ্রমণ পছন্দ করেন, তাদের জন্য ‘ভিয়া ট্রান্সিলভানিকা’ একটি আদর্শ গন্তব্য হতে পারে। এখানে একদিকে যেমন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, তেমনি স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গেও পরিচিত হওয়া যায়।
বর্তমানে, ‘স্লো সাইক্লিস্ট’ নামক একটি ভ্রমণ সংস্থা এই পথে সাইকেল ও হাইকিং ট্যুরের আয়োজন করে। তাদের ৫ রাতের বুয়াকোভিনা এক্সপিডিশন-এর খরচ জনপ্রতি প্রায় ১,৭৫০ পাউন্ড (প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার টাকার কাছাকাছি)।
সুতরাং, যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন এবং নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাদের জন্য রোমানিয়ার ‘ভিয়া ট্রান্সিলভানিকা’ হতে পারে একটি অসাধারণ গন্তব্য।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান