গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘মানবতার ধ্বংসযজ্ঞ’ চালানোর অভিযোগ, যুক্তরাজ্যের শীর্ষ আইনজীবীর মন্তব্য।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য – গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করা ১০ জন ব্রিটিশ নাগরিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন।
ফিলিস্তিন ভিত্তিক ‘ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস’ এবং যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট ল’ সেন্টার’ গত সপ্তাহে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের যুদ্ধাপরাধ ইউনিটের কাছে ২৪০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘হত্যা, গণহত্যা, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা, এবং জোরপূর্বক স্থানান্তরের’ মতো অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই মামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন ৮৩ বছর বয়সী প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী মাইকেল ম্যানসফিল্ড। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর দীর্ঘ ও উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা রয়েছে।
মানবাধিকারের এই কিংবদন্তী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেছেন। ম্যানসফিল্ডসহ আরও কয়েকজন আইনজীবী ও গবেষকদের একটি দল, যাঁরা গত ছয় মাস ধরে ব্রিটেন ও হেগে কাজ করেছেন, এই অভিযোগগুলো তৈরি করেছেন।
যুদ্ধাপরাধ ইউনিটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন আরও অনেক আইনজীবী, গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী। তাঁদের দাবি, এই অভিযোগগুলোর দ্রুত তদন্ত করা হোক।
মামলার সংবেদনশীলতার কারণে অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে ছিলেন বলে জানা গেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ৩১ মের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলো উন্মোচন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে উন্মুক্ত সূত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যানসফিল্ড এই মামলার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যা এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন।
ম্যানসফিল্ডের মতে, কোনো ব্রিটিশ নাগরিক যদি বিদেশে গুরুতর কোনো অপরাধ করে, তাহলে যুক্তরাজ্যের আইনে তাঁর বিচার হতে পারে। এখানেও তেমনটাই হচ্ছে।
তবে, এটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
যুক্তরাজ্য সরকার এক্ষেত্রে তদন্ত করতে পারে অথবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও (আইসিসি) এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে।
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই অবগত। আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থা এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে নিয়ম তৈরি হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল এমন ঘটনা প্রতিরোধ করা।
কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দেশের অসহযোগিতার কারণে জাতিসংঘের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না।
গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে বর্তমানে সেখানে প্রবেশ করা কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে গবেষক ও আইনজীবীরা কীভাবে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করলেন? ম্যানসফিল্ডের ভাষ্যমতে, অভিযুক্তদের চিহ্নিত করাই ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ।
তবে, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষকরা তাঁদের অনুসন্ধানে ‘বার্কলে প্রোটোকল’-এর সাহায্য নিয়েছেন। এই প্রোটোকল অনুযায়ী, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রমাণ তৈরি করা যায়।
আল জাজিরার ফুটেজ বা কারও ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের সেলফিও এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
এই মাসের শুরুতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রস্তুতি নিলে হাঙ্গেরি এই আদালত থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।
মানবাধিকার রক্ষার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যখন হুমকির সম্মুখীন, গণহত্যার মতো ঘটনা যখন অব্যাহত থাকে, তখন এই ধরনের আইনি পদক্ষেপের গুরুত্ব কতটুকু?
ম্যানসফিল্ডের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ কিছু মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে, যদিও অপরাধীদের মধ্যে এর কোনো প্রভাব নাও পড়তে পারে।
আইনজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে চান এবং মানুষের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চান। আইন ও বিচার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, সরকার যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
মানবাধিকার হলো সবার জন্য সমান। গাজায় যা ঘটছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর আক্রমণ।
ম্যানসফিল্ড গাজায় যা ঘটছে, তাকে গণহত্যা হিসেবেই দেখেন। তাঁর মতে, আত্মরক্ষার নামে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যেমন ইসরায়েল, মাত্রাতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করতে পারে না।
নারী, শিশু, চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণা প্রকাশ পেয়েছে, যা গণহত্যারই নামান্তর।
ইতিহাস এই মুহূর্তকে কীভাবে দেখবে জানতে চাইলে ম্যানসফিল্ড বলেন, তিনি চান, এই ঘটনা মানুষের হৃদয়ে পরিবর্তন আনুক। বিশ্বনেতাদের উচিত এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।
মানবাধিকার রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকেরই এই বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে।
এই ঘটনার সংক্ষিপ্তসারে ম্যানসফিল্ড বলেন, এটি মানবতাকে ধ্বংস করার এক বিশাল ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা