পার্কিনসন’স: জীবনের মোড় ঘোরানো এক রোগ, আর পরিবর্তনের পথে এক নারীর যাত্রা
জীবন সবসময় এক রকম থাকে না। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা আমাদের সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়। ঠিক তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন কিম্বার্লি ক্যাম্পানেলো। ৪১ বছর বয়সে তার পার্কিনসন’স রোগ ধরা পরে।
এই রোগটি তার জীবনযাত্রায় এনেছিল বিশাল পরিবর্তন। প্রিয় জুতা থেকে শুরু করে পোশাক—সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
কিম্বার্লির শৈশব কেটেছে আশি’র দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায়। কনভার্স অল স্টার ছিল তার প্রিয়, যা তিনি সবসময় পরতেন। বিয়ের দিনও তিনি সাদা পোশাকের সাথে পরেছিলেন সাদা চামড়ার কনভার্স। ইতালির রোম থেকে ভারতের মুম্বাই, এমনকি শিকাগো থেকে নরওয়ে—শহর থেকে শহর হেঁটে বেড়িয়েছেন এই জুতা পায়ে।
এছাড়াও, ফ্লাই লন্ডন বুটসের প্রতিও ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। পুরনো দিনের ফ্যাশন এবং আরাম দুটোই ছিল তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু বিধি বাম! ২০২১ সালে কিম্বার্লির জীবনে আসে এক কঠিন সত্য—পার্কিনসন’স। এটি এমন একটি রোগ যা ধীরে ধীরে শরীরের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। এর প্রধান উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—হাত-পা নাড়াতে সমস্যা হওয়া, বিশেষ করে হাঁটাচলার ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়া।
অনেক সময় শরীরের কিছু অংশে অনিয়ন্ত্রিত ও যন্ত্রণাদায়ক মোচড় লাগে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ডিসটোনিয়া’ বলা হয়। কিম্বার্লির ক্ষেত্রে, এই সমস্যাটি হতো কোমর, হাত, পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে।
যখন ওষুধ কাজ করত না, অথবা তিনি ক্লান্ত থাকতেন, তখন তার হাঁটাচলার ক্ষমতা কমে যেত। পায়ের আঙুলগুলো মাটিতে শক্ত হয়ে যেত, গোড়ালি বাঁকতো, অনেক সময় তিনি টাল সামলাতে না পেরে পরে যেতেন। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক দিক থেকেও তিনি ভেঙে পড়তেন।
পার্কিনসন’স শুধু তার চলাফেরার ধরন পরিবর্তন করেনি, বরং তার পোশাকের সাথে সম্পর্ককেও বদলে দিয়েছে। রোগ ধরা পড়ার পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, তার প্রিয় কনভার্সগুলো এখন হাঁটার জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ, জুতার হালকা ও নরম তলার কারণে পায়ের আঙুলে বাঁক ধরে যেত।
ফ্লাই বুটসও ছিল বিপদজনক—উঁচু তলার কারণে গোড়ালি বেঁকে যাওয়ার সম্ভবনা থাকত। এমনকি, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি অর্থোপেডিক জুতাও তিনি পরতে পারছিলেন না।
এরপর কিম্বার্লি বেছে নিলেন নাইকির ট্যাকটিক্যাল বুটস এবং ডাঙ্ক হাইস। এই জুতাগুলোর শক্ত তলা এবং গোড়ালির অতিরিক্ত সাপোর্ট তাকে সাহায্য করেছে। একসময় তিনিই নিয়মিত এই জুতা পরতে শুরু করেন।
তার প্রিয় কনভার্স এবং ফ্লাই বুটসগুলো তুলে রাখা হলো, কারণ তিনি জানতেন, হয়তো আর কোনোদিন সেগুলো পরা হবে না।
মনের মতো পোশাকও ধীরে ধীরে তার কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। তিনি তার পুরনো পোশাকগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ভিন্টেড’-এর মাধ্যমে তিনি তার জিনিসপত্র বিক্রি করা শুরু করেন।
ক্রেতাদের কাছ থেকে তিনি উষ্ণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন, কারণ তারা বুঝতে পারছিলেন, শারীরিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পোশাকের প্রয়োজনীয়তা কতখানি। কিম্বার্লি নিজেও নতুন পোশাকের জন্য এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে শুরু করেন।
পুরনো দিনের স্মৃতিবিজড়িত জুতাগুলো সহজে ছাড়তে পারেননি কিম্বার্লি। প্রথমে তিনি সেগুলোর দাম অনেক বেশি রাখলেও পরে একজোড়া বিক্রি করতে রাজি হন। ক্রেতাও ছিলেন কনভার্সের একনিষ্ঠ ভক্ত।
তিনিও একই রঙের একটি জুতা ব্যবহার করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কিম্বার্লিকে জুতাগুলো ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে জেনে তিনি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং ভালো থাকার পরামর্শ দেন।
বর্তমানে কিম্বার্লি সেই জুতা পরেন, যা তার জন্য আরামদায়ক। তিনি আগের মতো বেশি হাঁটাচলা করতে পারেন না, তবে এমন পোশাক ও জুতা পরেন যা তাকে স্বস্তি দেয়। তিনি এখন ভালো করেই জানেন, কোন জিনিসগুলো আমাদের কষ্টের কারণ হয়, আর কী ত্যাগ করতে হয়।
কিম্বার্লির এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দেয়, জীবনের পথ সবসময় সরল রেখায় চলে না। প্রতিকূলতাকে জয় করে কীভাবে নতুন করে বাঁচতে হয়, কিম্বার্লির জীবন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান