এমএস-এর পর হতাশা, ফিরে আসা! কিভাবে ‘ডায়াপার ইনফ্লুয়েন্সার’ হলেন?

শিরোনাম: এমএস রোগ: লড়াই করে সমাজে দৃষ্টান্ত, অনলাইনে সচেতনতা বাড়াচ্ছেন প্রী

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে, যেখানে উজ্জ্বল ছবি আর সাজানো গোছানো বিষয়বস্তু প্রায়ই প্রাধান্য পায়, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা নিয়ে যারা দিন কাটান, তাদের কঠিন বাস্তবতার কথা খুব কমই শোনা যায়।

শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি মানসিক এবং আবেগগত দিক থেকেও তারা অনেক চাপের মধ্যে থাকেন। এই ধরনের অসুস্থতা নিয়ে সমাজে এক ধরনের লুকোচুরি চলে, যার কারণে অনেকেই নীরবে কষ্ট পান।

প্রী নামের এক তরুণীর কথা ধরা যাক, যিনি ১৯ বছর বয়সে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (এমএস) রোগে আক্রান্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।

কারণ, এমএস-এর কারণে অনেক সময় তার স্মৃতিতে সমস্যা হতো। প্রথম বর্ষে দুটি বিষয়ে ফেল করার পর তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়েন, নিজেকে বোকা মনে হতে শুরু করে তাঁর।

এরপর যখন তিনি দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেন, তখন এমএস-এর কারণে তিনি হাঁটাচলার ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেন।

রোগ ধরা পড়ার পর একদিকে যেমন তিনি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছিলেন, তেমনই দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর জন্য আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল।

একদিকে স্বাস্থ্য, অন্যদিকে শিক্ষা—কোনটাকে তিনি বেশি গুরুত্ব দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।

অবশেষে, প্রী তাঁর অভিজ্ঞতার কথা অনলাইনে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৯ সালে তিনি ইউটিউবে প্রথম ভিডিও আপলোড করেন।

তিনি হয়তো ভাবেননি, তাঁর এই সামান্য চেষ্টাটাই তাঁকে সারা বিশ্বের কাছে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াপার’ বিষয়ক একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত করবে।

এর মাধ্যমে তিনি অসুস্থতা এবং ব্যক্তিগত দুর্বলতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ধারণা ভাঙতে শুরু করেন।

প্রী জানান, তাঁর প্রথম ভিডিওটির বিষয় ছিল ‘আমার মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস যাত্রা’। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো খুব বেশি হলে ছয় জন এটি দেখবেন।

কিন্তু এখন সেটির ভিউয়ার সংখ্যা ১৮,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ তাঁর কথা শুনছে!

প্রথমে হয়তো বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি পরিচিতি পেতে শুরু করেন, কারণ তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন, যা নিয়ে সাধারণত কেউ কথা বলতে চায় না।

ইউটিউবে তাঁর এই কাজকে প্রথমে পরিবারের পূর্ণ সমর্থন ছিল না। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এটা তাঁর ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না।

কিন্তু প্রী তাঁর এই পছন্দের কাজটি চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। অনলাইনে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তিনি যেন নতুন করে বাঁচার একটা পথ খুঁজে পান।

তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ যদি তাঁর কথা শোনে, তাহলে হয়তো তিনি নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারবেন।

প্রথমে প্রী চেয়েছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। তাঁর পরিবারও চাইছিল তিনি শিক্ষকতা করুন।

কিন্তু স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করার কথা ভাবলেই তিনি আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর তিনি মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ, পরিবারের সদস্যরা চাইছিল, তিনি একটা ‘নয়টা-পাঁচটা’ (নয়টা-থেকে-পাঁচটা) চাকরি করুন।

কিন্তু তিনি ভালো করে এক ঘণ্টা কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না।

নিজের পেশাগত জীবনের পাশাপাশি প্রী ব্যক্তিগত জীবনেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তাঁর বয়সের অনেক মেয়ের মতোই তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে, বিশেষ করে তাঁর সম্পর্কগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতেন।

এমএস-এর কারণে তাঁর শরীরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রস্রাবের সমস্যা হতো। বিষয়টি তাঁর জন্য খুবই বিব্রতকর ছিল।

ডেটিংয়ে গেলে প্রায়ই তাঁর পোশাক ভিজে যেত। তাঁর মনে হতো, ছেলেরা তাঁকে নিয়ে খারাপ ধারণা পোষণ করে।

এই ঘটনার পরেই তিনি তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করতে চান। কারণ, তাঁর বয়সের খুব কম মানুষকেই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ডায়াপার ব্যবহার করতে দেখা যায়।

প্রী বলেন, “আমি সবসময় ভাবতাম, আমার তো বয়স কম, তাহলে কেন আমি ডায়াপার পরব? ডায়াপার তো শুধু বৃদ্ধ বা শিশুদের জন্য।

তাই আমি এমন একজন হতে চেয়েছিলাম, যাকে আট বছর আগে আমি খুঁজেছিলাম।”

জীবনে চলার পথে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা হয়, যা মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। প্রীর ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে।

তাঁর অসুস্থতা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে একসময় তিনি বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন। এমনকি আত্মহত্যার চিন্তাও তাঁর মাথায় এসেছিল।

এই কঠিন সময়ে কীভাবে তিনি ইতিবাচক ছিলেন, জানতে চাইলে প্রী বলেন, তিনি তাঁর শরীরে ‘আশা’ শব্দটা ট্যাটু করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

প্রায় সাত বছর ধরে ভিডিও তৈরি করার পর প্রী অবশেষে তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন।

গত বছর তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াপার প্রস্তুতকারক দুটি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন, যার মাধ্যমে তিনি এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রী বলেন, “আমি যখন তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি, তখন একটু নার্ভাস ছিলাম। কারণ, আমি বুঝতে পারছিলাম না, তাঁদের সঙ্গে কাজ করাটা ঠিক হবে কিনা।

তবে তাঁরা আমার সব কাজে দারুণভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন।”

একটি কোম্পানি প্রীকে একটি কালো ডায়াপার দেয়, যেটি তাঁর আকারের চেয়ে বড় ছিল। কিন্তু তিনি এর মধ্যেই মজা খুঁজে নিয়েছিলেন।

প্রী বলেন, “ডায়াপারটা দেখে আমার মনে হয়েছিল, এটা একটা ময়লার ব্যাগ। এরপর আমি চিন্তা করলাম, যা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেই বিষয়গুলো নিয়ে এত নেতিবাচক না থেকে বরং মজা করা যাক।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পর তিনি তাঁর ফলোয়ারদের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পান। সবাই তাঁর এই বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।

প্রী মনে করেন, ভিন্নতাই সুন্দর। তিনি অন্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “অপূর্ণতাকে নিখুঁত করার চেষ্টা করবেন না, বরং যা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, তা গ্রহণ করুন।”

যদি কোনো ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যায় ভুগে থাকেন, তবে সাহায্য চেয়ে 741-741 নম্বরে ‘STRENGTH’ লিখে মেসেজ করতে পারেন।

তথ্য সূত্র: People

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *