মার্কিন চাপে কি দ্রুত অস্ত্র ছাড়বে হিজবুল্লাহ?

লেবাননে হিজবুল্লাহর অস্ত্র কমিয়ে আনার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, এমনটাই খবর। এই ইস্যুতে একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়, তেমনি লেবাননের কিছু রাজনৈতিক দলও চাইছে হিজবুল্লাহ অস্ত্র জমা দিক।

ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। গত বছর ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা নিহত হন এবং বহু বেসামরিক নাগরিক, যাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন শিশুও ছিল, নিহত হয়।

সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসনের পতনের ফলে হিজবুল্লাহ আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূত, মরগান ওর্টাগাস, সম্প্রতি লেবানন সফরকালে দেশটির একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করতে হবে, এবং ইসরায়েল তাদের উপর সন্ত্রাসীদের হামলা মেনে নেবে না।’ তিনি আরও বলেন, হিজবুল্লাহকে একটি ‘ক্যান্সারের’ মতো বিবেচনা করে নির্মূল করতে হবে।

একইসাথে, হিজবুল্লাহ যাতে ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে, সেজন্য অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং সংস্কার জরুরি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননের গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে হিজবুল্লাহ বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। একদিকে তারা অস্ত্র জমা দিতে চাইছে না, কারণ এর বিনিময়ে তারা বড় সুবিধা আদায় করতে চায়।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে। এছাড়া, ইসরায়েল এখনো লেবাননের ওপর হামলা চালাচ্ছে, যার কারণ হিসেবে তারা ‘হিজবুল্লাহর সদস্যদের’ দায়ী করে।

তবে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি। তারা জানে যে তাদের সমর্থিত অনেক মানুষের ঘরবাড়ি পুনর্গঠনের জন্য বিদেশি সাহায্য প্রয়োজন, যা সরকারের মাধ্যমে আসবে।

লেবাননের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ডক্টরাল শিক্ষার্থী কারিম সাফিদ্দিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, হিজবুল্লাহ ‘নীতিগতভাবে অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি নয়’। তবে তারা ‘বড় সুবিধা’র বিনিময়ে তা করতে পারে।

রয়টার্স সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েল যদি দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি স্থান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে হিজবুল্লাহ অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে।

যদিও পরে হিজবুল্লাহর মিডিয়া অফিস এই খবর অস্বীকার করেছে।

লেবাননের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাসেম কাসির, যিনি হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত, বলেন, ‘হিজবুল্লাহ একটি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরি করতে রাজি, তবে তারা অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবে না। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব বজায় থাকলে, বর্তমানে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়।’

তবে ইসরায়েল যদি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে কী হবে, তা আমি জানি না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৮ মাস আগেও হিজবুল্লাহর যে ক্ষমতা ছিল, এখন তা নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডারের বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে এবং সামরিক নেতৃত্বও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হিজবুল্লাহর অস্ত্র পাওয়ার প্রধান পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

যদিও হিজবুল্লাহ এখনো দক্ষিণ লেবাননের অনেক অঞ্চলে সমর্থন ধরে রেখেছে, কিন্তু লেবাননের সামরিক বাহিনী বর্তমানে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নিজেদের হাতে নিয়েছে।

একজন পশ্চিমা কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়েছে, কিন্তু তারা এখনো লেবাননের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী। তারা এখন আর ইসরায়েলকে ভয় দেখাতে বা হুমকি দিতে পারে না, তবে অভ্যন্তরীণভাবে তারা এখনো হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।’

কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, হিজবুল্লাহ কোণঠাসা হয়ে পড়লে, তারা প্রতিশোধ নিতে পারে, যা দেশে গৃহযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। কাসেম কাসির বলেন, ‘চাপ অনেক বেশি, তবে আমি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছি না।’

লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন এবং হিজবুল্লাহকে একটি বার্তা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং আলোচনার মাধ্যমে এটি কার্যকর করা হবে, কোনো ধরনের শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।’

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও প্রেসিডেন্ট আউনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

তবে এই পদক্ষেপ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী নাওয়াফ সালামের সরকারের ওপর আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সিনিয়র ফেলো নাতাশা হল আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এই শক্তিগুলো মূলত মনে করে, এই নরম পদক্ষেপ হিজবুল্লাহকে পুনরায় সংগঠিত হতে সাহায্য করবে এবং যথেষ্ট কঠোর নয়।’

লেবাননের কিছু দলও এই মতের সঙ্গে একমত। এর মধ্যে রয়েছে লেবানিজ ফোর্সেস (এলএফ), একটি ডানপন্থী খ্রিস্টান দল, যাদের সালামের সরকারে চারজন মন্ত্রী রয়েছেন।

এলএফের শীর্ষস্থানীয় দুই নেতা, সামির গিয়াগিয়া ও জর্জেস আডওয়ান, কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।

গিয়াগিয়া হিজবুল্লাহর অস্ত্র নিয়ে জাতীয় সংলাপের ধারণার সমালোচনা করেছেন এবং ছয় মাসের মধ্যে একটি সময়সীমা নির্ধারণের কথা বলেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিজবুল্লাহর অস্ত্রের বিষয়টি ওয়াশিংটন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের ইরান বিষয়ক আলোচনার ওপরও নির্ভরশীল। ইরান হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের সমর্থক।

সম্প্রতি ওমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে এবং আগামী সপ্তাহে ইতালিতে আরও একটি বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।

যদিও এই আলোচনার মূল বিষয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরানের সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোও আলোচনার বিষয় হতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিলাল খাশান বলেছেন, ‘ইরান যদি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে চায় এবং লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকের প্রতিরোধ অক্ষকে সমর্থন করতে চায়, তাহলে তাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। হিজবুল্লাহকে বুঝতে হবে যে তাদের অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে। সম্ভবত লেবাননের অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং সামরিক সক্ষমতার কারণেই এটি ঘটবে।’

হিজবুল্লাহর অস্ত্র ত্যাগ করার সম্ভাবনা তাদের ৪০ বছরের ইতিহাসে সম্ভবত এখন সবচেয়ে বেশি। তবে কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে লেবাননের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি এবং হিজবুল্লাহর সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা উচিত।

সাফিদ্দিন বলেন, ‘শিয় সম্প্রদায়র মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের একটি নতুন অনুভূতি তৈরি করতে হবে এবং তাদের অনুভব করাতে হবে যে রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।’

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *