আমেরিকা ছেড়ে স্পেনে: বৃদ্ধ বয়সে নতুন জীবনের খোঁজে এক পরিবার

বদলে যাওয়া জীবন: আমেরিকার জীবন ছেড়ে স্পেনে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয়, এক পরিবারের নতুন যাত্রা।

এক সময়ের স্বপ্নের দেশ আমেরিকা, যেখানে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বহু মানুষ, সেই আমেরিকাতেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ৫৬ বছর বয়সী কারিনা নুভো। ভালো জীবন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় যারা এসেছিলেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে সেই আমেরিকাকেই বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল একদিকে যেমন কর্মজীবনের চাপ, তেমনই ছিল আমেরিকার রাজনৈতিক অস্থিরতা।

কারিনা জানান, তিনি পেশায় একজন শিল্পী। সঙ্গীতের জগতে পরিচিতি থাকলেও, জীবন ধারণের জন্য রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ও প্রপার্টি ম্যানেজারের কাজও করতে হতো তাকে। একদিকে গানের জগৎ, অন্যদিকে বাড়ির দেখাশোনা—সবকিছু সামলাতে গিয়ে মানসিক শান্তির বড় অভাব দেখা দেয় তার।

এর মধ্যে যুক্ত হয় অসুস্থ বাবার দেখাশোনার চাপ। সব মিলিয়ে, তিনি এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।

২০২৪ সালের মে মাসে, যখন আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার কারণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কারিনার কাছে মনে হয়—যেন সবকিছু তার সহ্যশক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে।

তখনই তিনি ইউরোপে, বিশেষ করে স্পেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

কারিনার বাবা হোসে নুভো (পেশাগত কারণে কারিনা তার পদবিতে সামান্য পরিবর্তন এনেছেন) ছিলেন কিউবার নাগরিক। ভালো জীবনের আশায় একুশ বছর বয়সে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান।

কিন্তু হোসের বাবা, অর্থাৎ কারিনার ঠাকুরদা, স্পেনের নাগরিক ছিলেন। ফলে, স্পেনের ‘লেই দে নিয়েতোস’ বা ‘নাতি-নাতনি আইন’ অনুযায়ী, হোসে এবং তার সন্তানদের স্পেনের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ ছিল।

এই আইন অনুযায়ী, যারা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ এবং ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনে নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাদের বংশধররা স্পেনের নাগরিকত্ব পেতে পারেন।

কারিনা তার বাবাকে জানান, তিনি স্পেনে গিয়ে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন।

তখন ৮৭ বছর বয়সী হোসে জানান, তিনি আর আমেরিকায় থাকতে চান না।

মেয়ের সঙ্গে তিনিও স্পেনে যেতে রাজি হন।

এরপর কারিনা তাদের জিনিসপত্র বিক্রি শুরু করেন এবং স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

২০২২ সালে একবার বাবা ও মেয়ের স্পেন যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু যাওয়ার আগে হোসে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সেই যাত্রা সফল হয়নি।

অবশেষে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তারা স্পেনে পৌঁছান।

স্পেনে যাওয়ার পর কারিনার মা ও সৎ বাবাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

তারাও কিউবা থেকে এসে দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় বসবাস করছিলেন।

তাদেরও স্পেনের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ ছিল। কারণ, তাদের পূর্বপুরুষ স্পেনের নাগরিক ছিলেন।

অবশেষে, তারাও স্পেনে চলে আসেন এবং সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন।

কারিনার সৎ বাবা সিজার জানান, আমেরিকার জীবনযাত্রার উচ্চ খরচ এবং সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের স্পেন যেতে উৎসাহিত করেছে।

বর্তমানে, কারিনার বাবা মারবেলা শহরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন।

সেখানে তিনি ভালোভাবে সময় কাটাচ্ছেন।

কারিনা জানান, স্পেনে তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে।

সেখানে জীবনযাত্রার খরচও আমেরিকার তুলনায় অনেক কম।

স্পেনে তারা ফুয়েনগিরোলা শহরে একটি সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছেন, যার মাসিক ভাড়া ছিল ১,১০০ ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১,২৭,০০০ টাকা)।

এখানে তারা শান্তিপূর্ণভাবে জীবন অতিবাহিত করছেন।

কারিনার মতে, স্পেনে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানসিক, আবেগিক ও শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখা।

তিনি মনে করেন, তারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছেন।

কারিনা জানান, তিনি এখনও ক্যালিফোর্নিয়াকে ভালোবাসেন, তবে এখন তিনি স্পেনে থাকতে পেরে খুশি।

অন্যদিকে, হোসে নুভো তার জীবনকে একটি ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হিসেবে দেখেন।

তিনি বলেন, তিনি সবসময় নতুন কিছু করতে ভালোবাসেন।

তার মতে, জীবনকে উপভোগ করা উচিত।

যারা এমন পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, তাদের প্রতি তার পরামর্শ হলো— নিজের হৃদয়ের কথা শোনো এবং ভয় পেও না।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *