স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, এমনকি জীবন রক্ষাকারী অনেক চিকিৎসা প্রযুক্তি—এগুলোর পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অর্থায়নে হওয়া গবেষণা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফেডারেল সরকারের তহবিল কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এই উদ্ভাবনগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে ফেডারেল সরকারের দেওয়া অনুদান কমিয়ে দেওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ। এর ফলে, উন্নত বিশ্বের গবেষণায় দেশটির যে নেতৃত্ব, সেটিও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা ইন্টারনেট, জিপিএস, কিংবা আইফোনের টাচস্ক্রিন—এগুলোর উদ্ভাবনে সরকারি অর্থায়নের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই বিষয়ে আমেরিকান কাউন্সিল অন এডুকেশনের সরকারি সম্পর্ক বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জন ফ্যানস্মিথ সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি এই প্রশাসন বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এক প্রজন্মের ক্ষতি করে, তবে সেটা বাড়িয়ে বলা হবে না। এর প্রভাব প্রত্যেক আমেরিকানের ওপর পড়বে, তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই হোক না কেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন মূলত আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে একমত করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে, তারা গবেষণা খাতে তহবিল বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গারবার জানিয়েছেন, তারা তহবিলের জন্য সরকারের কোনো শর্ত মেনে তাদের স্বাধীনতা বা সাংবিধানিক অধিকার ত্যাগ করবে না। তবে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে একেকটি ছোট শহরের মতো, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং গবেষক কাজ করেন। তাদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আসে বিভিন্ন উৎস থেকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত রাজ্য ও স্থানীয় সরকার এবং শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত অনুদানের ওপর নির্ভরশীল।
উদাহরণ হিসেবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যায়। গত বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ৪৫ শতাংশ এসেছে অনুদান থেকে। হার্ভার্ডের বিশাল একটি তহবিল (এন্ডোমেন্ট) রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এটি দেশটির যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি। তবে, এই অর্থ ব্যবহারের কিছু নিয়ম রয়েছে। এই তহবিল থেকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থই খরচ করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (এনআইএইচ) থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পায় জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছর তারা এই সংস্থা থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল পেয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণা পরিচালনার জন্য ফেডারেল সরকার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ২০২৪ অর্থবছরে গবেষণা খাতে প্রায় ৬৮৬ মিলিয়ন ডলারের বেশি ফেডারেল তহবিল পেয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যদি তাদের তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ ইউএসএআইডি-র তহবিল কমানোর ফলে তারা প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমেরিকার সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেকার সম্পর্ককে নতুন রূপ দেয়। যুদ্ধের আগে, অ্যান্ড্রু কার্নেগি ও জন ডি. রকফেলারের মতো শিল্পপতিরা তাদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে গবেষণা চালাতেন। তবে, প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট মনে করতেন, যুদ্ধ জয়ের জন্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অপরিহার্য। তাই, ১৯৪১ সালে তিনি অফিস অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওএসআরডি) তৈরি করেন। এই সংস্থাটি দেশের সেরা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একত্রিত করে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি তৈরি করতে সহায়তা করে। ওএসআরডি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রকল্পের জন্য অর্থ দেয়। এর ফলস্বরূপ, পারমাণবিক বোমা, রাডার, এবং চিকিৎসা ও সামরিক প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আসে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওএসআরডি বিলুপ্ত হয়, কিন্তু সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেকার এই অংশীদারিত্ব আমেরিকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির পথ খুলে দেয়। এই সম্পর্ক গত ৭০ বছর ধরে চলে আসছিল, যা বর্তমানে হুমকির মুখে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং জ্বালানি বিভাগ—এগুলো বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ সরবরাহ করে। এই অর্থ সরাসরি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে যায় না। বরং, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের জন্য ফেডারেল সরকারের কাছ থেকে অনুদানের জন্য আবেদন করে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় ফেডারেল সরকারের এই অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টবি স্মিথ, যিনি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমিতির (অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকান ইউনিভার্সিটিজ) সরকারি সম্পর্ক বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, তিনি এই বিষয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা জাতীয় গবেষণাগারের মতো।
স্মিথ আরও যোগ করেন, সরকার যদি কলম্বিয়া বা হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তবে এর ফলে সেরা গবেষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, এই গবেষকরা ক্যান্সারের চিকিৎসা, আলঝেইমার রোগ, শিশুদের রোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এই গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশটি পিছিয়ে পড়বে। অন্যান্য দেশগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। এর ফলে, আমেরিকান জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন