হাইতির স্বাধীনতা দিবসে ফ্রান্সের ‘মুক্তিপণ’ ফেরত চেয়ে কান্নার রোল!

হাইতির স্বাধীনতা সংগ্রামের দুইশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ফ্রান্সের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে দেশটি। হাইতির জনগণের দাবি, ফরাসি সরকার যেন তাদের কাছ থেকে আদায় করা বিশাল অঙ্কের ‘মুক্তিপণ’ ফেরত দেয়। এই অর্থ পরিশোধ করা হলে হাইতিকে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ১৮০৪ সালে হাইতি স্বাধীনতা অর্জন করার পর, ফ্রান্স ক্ষতিপূরণ হিসেবে হাইতির উপর ১৫ কোটি ফ্রাঙ্ক চাপিয়েছিল। যদিও পরে এই অঙ্ক কমে ৯ কোটি ফ্রাঙ্কে দাঁড়ায়, তবে বর্তমান মূল্যে এই অর্থের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন থেকে ১৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাইতির জাতীয় ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার কমিটির (এইচএনসিআরআর) প্রেসিডেন্ট ফ্রিজ দেশোমিসের মতে, এই বিশাল পরিমাণ অর্থ পরিশোধের ফলে হাইতির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

একসময় ক্যারিবীয় অঞ্চলে ফ্রান্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ ছিল হাইতি। ফরাসি সরকার হাইতি থেকে দাস শ্রমিকদের ধরে এনে এখানে বিক্রি করত। হাইতির স্বাধীনতা অর্জনের পর ফ্রান্সের পক্ষ থেকে এই ‘মুক্তিপণ’-এর দাবি আসে, যা হাইতির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। এইচএনসিআরআর সদস্য জঁ মোজার্ট ফেরন বলেন, এই মুক্তিপণ হাইতিকে এমন একটি অর্থনৈতিক চক্রে ফেলেছিল, যা থেকে দেশটি আর কখনোই পুরোপুরি মুক্তি পায়নি।

এর ফলে হাইতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় এবং শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের সুযোগও কমে যায়। এই ঋণের কারণে হাইতিতে গভীর দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। হাইতির এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলেও দেশটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

কোলেক্টিফ আয়িসিয়েন আফ্রোদেসান নামক একটি নাগরিক সমাজের মুখপাত্র মনিক ক্লেস্কা বলেছেন, এই ‘দানবীয় ঋণ’ হাইতিকে কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যেতে বাধা দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এর ফল হয়েছে, দেশটি কার্যত একটি নব্য-উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল, যা ফ্রান্সের কাছে অর্থনৈতিক, প্রতীকী ও রাজনৈতিকভাবে আবদ্ধ ছিল।

ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ফ্রান্সকে এই ‘মুক্তিপণ’ ফেরত দিতে এবং দাসত্ব ও উপনিবেশবাদের কারণে হওয়া ক্ষতির প্রতিকার করতে বলছে। ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি (ক্যারিকম) হাইতির এই দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। জাতিসংঘের এক ফোরামে ক্যারিকমের সেক্রেটারি-জেনারেল ড. কার্লা বার্নেট হাইতির জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।

তিনি বলেন, “ঐতিহাসিক এই অবিচারের নেতিবাচক অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব আজও হাইতিতে দৃশ্যমান। এই ঘটনার বার্ষিকী হাইতির পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করার সুযোগ তৈরি করেছে।” এইচএনসিআরআর মনে করে, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ফ্রান্স ও হাইতির মধ্যে একটি সমঝোতা হতে পারে।

হাইতি কীভাবে ক্ষতিপূরণের অর্থ ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ অধিকার তাদের থাকবে। হাইতির নাগরিকরা মনে করেন, ১৮২৫ সালে ফরাসি সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য ফরাসি জনগণের কোনো দায় নেই। তবে, হাইতির জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে তাদের এই উদ্যোগে সমর্থন জানানো উচিত।

বর্তমানে হাইতি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ২০২১ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইসের হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এরপর, গ্যাং সহিংসতার কারণে দেশটির অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্থিতিশীল সরকার ও সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তার চেষ্টা করছে, তবে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ফেরন মনে করেন, হাইতির বর্তমান পরিস্থিতি ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের কমিটি হাইতি সরকারকে পরামর্শ দেবে, কীভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে এই অর্থ ব্যবহার করা যায়।”

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *