বিশ্বের বৃহত্তম মাংস প্রস্তুতকারক কোম্পানি জেবিএস (JBS), আমাজন বৃষ্টিবনে বনভূমি ধ্বংসের অঙ্গীকার রক্ষা করতে আবারও ব্যর্থ হতে পারে।
জানা গেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের গরুর মাংস সরবরাহ শৃঙ্খলকে বনভূমি ধ্বংসের প্রভাবমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে, তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ব্রাজিলের প্যারার (Pará) এবং রনডোনিয়া (Rondônia) রাজ্যের কয়েক হাজার খামারের প্রতিনিধি, কৃষক এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে জেবিএস-এর পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে বলে অনেকেই মনে করেন।
বনভূমি ধ্বংসের মূল কারণ হলো গবাদি পশু পালন, যার জন্য গাছপালা কেটে ফেলা হয়।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, এর ফলে আমাজন কার্বন শোষক থেকে নির্গমনকারী অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
জেবিএস-এর পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, তারা তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে স্বচ্ছতা আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
তারা ৪০,০০০ এর বেশি নিবন্ধিত সরবরাহকারীর সঙ্গে কাজ করে এবং বনভূমি ধ্বংসের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে।
তবে, মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বলছেন, বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
একজন কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “কোম্পানিটির ইচ্ছা আছে, আমাদেরও আছে।
কিন্তু বনভূমি ধ্বংস মুক্ত করার যে লক্ষ্য, তা পূরণ করা কঠিন।
তিনি আরও যোগ করেন, অবৈধভাবে গবাদি পশু সরবরাহ বন্ধ করাও সময়সাপেক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে গার্ডিয়ান, Unearthed এবং Repórter Brasil-এর সাংবাদিকদের একটি দল ৩৫ জনের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে।
তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, জমির মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা এবং প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে জেবিএস-এর পক্ষে সময় মতো এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
প্যারার রাজ্য সরকারের সমর্থন রয়েছে এমন একটি ট্যাগিং প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৬ সালের মধ্যে রাজ্যের ২ কোটি ৬০ লক্ষ গরুর উপর নজরদারি করার পরিকল্পনা করছে জেবিএস।
রাজ্যপাল হেলডার বারবালহো (Helder Barbalho) এই প্রকল্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, জেবিএস সময়সীমা পূরণ করতে পারবে।
তবে, ছোট কৃষকদের জন্য আরও বেশি সহায়তার প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এই প্রকল্পের জন্য বেজোস আর্থ ফান্ড ১৪৩ মিলিয়ন রিয়েল (প্রায় ২,৯০০ কোটি টাকা) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে, কৃষক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং জমির মালিকানা নিয়ে অনিশ্চয়তা জেবিএস-এর জন্য বড় বাধা।
তাঁদের মতে, অনেক খামার তৈরি হয়েছে সরকারি জমি জবরদখল করে, ফলে এই সমস্যার সমাধান সময়মতো করা সম্ভব নয়।
এই বিষয়ে টুকুমã-ঔরিলান্ডিয়া গ্রামীণ উৎপাদক ইউনিয়নের কর্মী অ্যাডেলোসমার আন্তোনিও ওরিও (Adelosmar Antonio Orio) বলেন, “এই বছর শেষ হওয়ার আগেই আমাদের জমির সমস্যা ও পরিবেশগত সব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অবৈধভাবে গবাদি পশু সরবরাহ বা ‘ক্যাটােল লন্ডারিং’-এর অভিযোগ।
অনেক সরবরাহকারী মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে তাঁদের পশুর পরিবেশগত রেকর্ড পরিবর্তনের চেষ্টা করেন।
উদাহরণস্বরূপ, অবৈধভাবে বনভূমি ধ্বংস করে উৎপাদিত পশু অন্য কোথাও জবাই করে কম দামে জেবিএস-এর কাছে বিক্রি করা হয়।
জেবিএস যদিও তাদের পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি, তবে তারা দাবি করেছে, তাদের বার্ষিক গরুর মাংস কেনার ৮০ শতাংশের বেশি ব্লকচেইন-ভিত্তিক একটি প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধিত হয়েছে।
অতীতেও জেবিএস-এর বিরুদ্ধে বনভূমি ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে।
নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিটিয়া জেমস (Letitia James) কোম্পানির বিরুদ্ধে ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন।
১৫ জন মার্কিন সিনেটরের একটি দল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (Securities and Exchange Commission) জেবিএস-এর শেয়ার তালিকাভুক্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
জেবিএস স্বীকার করেছে যে, তারা বনভূমি ধ্বংসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং এই চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল।
কোম্পানিটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, তারা বনভূমি ধ্বংস মুক্ত করার জন্য নীতি তৈরি করেছে, সরবরাহ শৃঙ্খলের উপর নজরদারি করছে এবং কৃষকদের বিনামূল্যে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।
এছাড়াও, আমাজন অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের জন্য জেবিএস ফান্ড ফর দ্য আমাজন (JBS Fund for the Amazon) নামে একটি তহবিলও গঠন করা হয়েছে।
তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কোম্পানির পক্ষে এই বিশাল সমস্যার সমাধান করা কঠিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে, আমাজনের বনভূমি ধ্বংসের মতো ঘটনাগুলো শুধু ব্রাজিলের নয়, বরং পুরো বিশ্বের পরিবেশের জন্য উদ্বেগের কারণ।
এর প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
তথ্য সূত্র: The Guardian