বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সমুদ্র উপকূলগুলোতে প্রতি বছর এমন কিছু উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক দারুণ মেলবন্ধন ঘটায়। নাচ, গান আর নানা ধরনের আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে সেখানকার মানুষ।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে বিশ্বের তেমনই সাতটি ভিন্নধর্মী উপকূলীয় উৎসবের কথা তুলে ধরা হয়েছে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আসুন, সেই উৎসবগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ফ্রান্সের মেনটন শহরে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ফেত দু সিট্রন’ উৎসব। এখানকার মানুষেরা ১৬ শতাব্দি থেকে লেবু চাষ করে আসছে।
এই উৎসবে তারা তাদের প্রিয় ফলটিকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে। পুরো শহরটি যেন এক কল্পনালোকের সৃষ্টি করে, যেখানে ১৫0 টনেরও বেশি লেবু এবং কমলালেবু দিয়ে তৈরি বিশাল আকারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।
এই ভাস্কর্যগুলোতে সমুদ্রের প্রাণী থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপত্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। উৎসবের সময় প্যারেড, স্থানীয় খাদ্য উৎপাদনকারীদের সাথে সাক্ষাৎ এবং লেবু-ভিত্তিক বিভিন্ন খাবার উপভোগ করার সুযোগ থাকে।
উৎসব শেষে উদ্বৃত্ত লেবু দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু জ্যাম।
পেরুর পুনো শহরে, টাইটিকাকা লেকের পাশে অনুষ্ঠিত হয় ‘ফিয়েস্তা দে লা ক্যান্ডেলারিয়া’। আদিবাসী রীতি এবং ক্যাথলিক ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায় এই উৎসবে।
ফেব্রুয়ারি মাসের এই উৎসবে স্থানীয়রা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করে, গান গায় এবং আনন্দ করে। এখানকার আকাশে ফায়ারওয়ার্কের ঝলকানি উৎসবের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তোলে।
এই উৎসবে ভার্জিন অফ ক্যান্ডেলারিয়া এবং ‘পাচামামা’ (পৃথিবী মাতা)-কে সম্মান জানানো হয়। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ‘লা ডায়াব্লাদা’ নামে পরিচিত এক ধরনের ডেভিল ডান্স, যেখানে আন্দিয়ান পোশাক ও মুখোশ পরিহিত নর্তকেরা বাঁশি বাজিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন।
পর্তুগালের আজোর দ্বীপপুঞ্জের সাও মিগুয়েল দ্বীপে এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ট্রেমর’ নামক একটি সঙ্গীত উৎসব। আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে অবস্থিত এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন উৎসবের শিল্পসম্মত পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
এই উৎসবে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত পরিবেশন করেন, যার মধ্যে লোকসংগীত, জ্যাজ, সাইকেডেলিক এবং রক উল্লেখযোগ্য। চার্চ এবং পরিত্যক্ত খনিগুলোর মতো необы जगहोंে এই উৎসবের নানা আয়োজন করা হয়, যা দর্শকদের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা দেয়।
থাইল্যান্ডে এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডের নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ‘সংক্রান’ উৎসব। এই উৎসব নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর একটি বিশেষ মুহূর্ত, যখন স্থানীয়রা তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে সুগন্ধি জল উৎসর্গ করে।
শিশুরা তাদের বয়স্কদের হাত ধুইয়ে দেয়। তবে রাস্তার উৎসবগুলো আরও বেশি মজাদার হয়ে ওঠে জলকেলীর মাধ্যমে। বিশেষ করে ফুকেট ও ক্রাবির মতো উপকূলীয় এলাকাগুলোতে চলে জলযুদ্ধ।
সবাই জলকামান ও জলভর্তি বোমা ব্যবহার করে একে অপরের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। জল খেলার পাশাপাশি এই উৎসবে সঙ্গীত, ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা এবং মন্দিরগুলোতে বিশেষ পূজা-অর্চনারও আয়োজন করা হয়।
নরম্যান দ্বীপপুঞ্জের ট্রোনা দ্বীপে জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ট্রোনাফেস্টিভালেন’ উৎসব। এই উৎসবে দিন-রাতের প্রায় ২৪ ঘণ্টা জুড়েই চলে আনন্দ-উৎসব।
নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে ফেরিতে করে এই দ্বীপে যেতে হয়। আর্কটিক সার্কেলে অবস্থিত এই উৎসবে বিশ্বখ্যাত ডিজে এবং সঙ্গীতশিল্পীরা পারফর্ম করেন, যা দর্শকদের জন্য একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
এখানকার গভীর বনভূমি থেকে শুরু করে ‘কিরখেহেলেরেন’-এর মতো বিশাল গুহাগুলোতেও কনসার্টের আয়োজন করা হয়।
যুক্তরাজ্যের সিলির দ্বীপপুঞ্জে আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘ওশেন সিলি’ উৎসব। কর্নওয়ালের উপকূল থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জের স্বচ্ছ জলরাশি আর সাদা বালুকাময় সৈকত একে প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমিতে পরিণত করেছে।
উৎসবটি এখানকার সমুদ্র ঐতিহ্যকে উদযাপন করে। এখানে রক পুল সাফারি, গিগ (ছোট ডিঙি নৌকা) রেসিং, জাহাজ ধ্বংসাবশেষের ভ্রমণ, সূর্যাস্তকালীন সাঁতার, সিল মাছ দেখা এবং কায়াকিংয়ের মতো বিভিন্ন কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও, দ্বীপগুলোতে সুন্দর উপকূলীয় পথ ধরে হাঁটা এবং নানান ধরনের বন্য ফুলের বাগান দেখা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার হারমানাস-এ সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় ‘হারমানাস হোয়েল ফেস্টিভাল’। দক্ষিণ মহাসাগরের শীতল জল থেকে শত শত তিমি মাছ উষ্ণ জলের খোঁজে এখানে আসে।
এই উৎসব তিমি দেখা এবং স্থানীয় সামুদ্রিক জীবন ও সংরক্ষণের উপর সচেতনতা তৈরি করার একটি দারুণ সুযোগ তৈরি করে। এই উৎসবে লাইভ সঙ্গীত, স্থানীয় খাবার এবং হস্তশিল্পের মেলাও বসে।
এগুলো ছাড়াও, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন আরও অনেক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে এইসব উৎসবে অংশগ্রহণ করা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দিতে পারে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক