সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ, তোলপাড়!

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (International Court of Justice – ICJ) সুদানের করা একটি মামলার শুনানি চলছে, যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে (UAE) সুদানে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সুদানের অভিযোগ, দেশটির সশস্ত্র বাহিনী আরএসএফকে (Rapid Support Forces – RSF) অস্ত্র সরবরাহ করে আমিরাত গণহত্যায় সহায়তা করেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি রায় দেবে।

সুদানের ভারপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী মুয়াবিয়া ওসমান হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে জানান, “সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তা ছাড়া সুদানে চলমান গণহত্যা সম্ভব হতো না। আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে তারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত।” সুদান চাইছে, আদালত যেন আমিরাতকে আরএসএফকে সমর্থন বন্ধ করতে এবং যুদ্ধের শিকার হওয়া মানুষদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে।

অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা রিম কেটাইত আদালতের কাছে জানান, “সুদানের এই ভয়াবহ সংঘাতের পেছনে আমিরাতের হাত রয়েছে – এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই মামলা মূলত আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থা অপব্যবহার করে আমিরাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর একটি প্রয়াস।” তিনি আরও বলেন সুদানের অভিযোগগুলো হয় বিভ্রান্তিকর, নয়তো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এই মামলার রায় নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সেটি হলো, জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনে (Genocide Convention) স্বাক্ষর করার সময় আমিরাত একটি ‘সংরক্ষণ’ যুক্ত করেছিল। এই সংরক্ষণে বলা হয়েছিল, গণহত্যা বিষয়ক কোনো বিতর্কের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার তারা মানবে না। আমিরাতের মতে, এই সংরক্ষণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের প্রাথমিক রায় দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই আদালতের।

যদি আদালত সুদানের অভিযোগ খারিজ করে দেয়, তবে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমিরাতের ভাবমূর্তির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কারণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের একটি সম্মানজনক অবস্থান রয়েছে। তবে, মামলার কারণে আরএসএফকে সমর্থন যোগানোর সঙ্গে জড়িত দেশগুলোকে ভবিষ্যতে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও সতর্ক হতে হবে।

২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে সুদানে সামরিক বাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। রাজধানী খার্তুমে শুরু হওয়া এই সংঘাত ধীরে ধীরে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। উভয় পক্ষই যুদ্ধের সময় নানা ধরনের নৃশংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপের সুযোগ সীমিত। তবে, মিশরের মতো আঞ্চলিক শক্তি, যাদের সুদানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা বেশি। দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে আমিরাতের বিরুদ্ধে, যদিও তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

বিশ্লেষকদের মতে, সুদানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং রাজনৈতিক ইসলামের বিস্তার রোধ করতে চায় আমিরাত। আমিরাতের নিরাপত্তা বিশ্লেষণে, রাজনৈতিক ইসলাম তাদের জন্য একটি হুমকি।

সুদানের এই মামলার শুনানির দ্রুত নিষ্পত্তির কারণ হলো, গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। সুদান গত ৫ মার্চ এই মামলা দায়ের করে।

সুদানের পক্ষে আইনি লড়াই করা অধ্যাপক আইরিক বিজোর্গ আদালতে বলেন, “বর্তমানে মাসালিত সম্প্রদায়ের উপর যে গণহত্যা চলছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন গুরুতর প্রমাণ রয়েছে যে, আমিরাত এই গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা এতে সহায়তা করছে।”

অধ্যাপক বিজোর্গ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেলের বক্তব্য উল্লেখ করেন। এই প্যানেল, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, এমন অভিযোগকে “বিশ্বাসযোগ্য” হিসেবে উল্লেখ করেছে যে, আমিরাত থেকে আসা কার্গো বিমানগুলো চাদের একটি বিমানবন্দরে আরএসএফের জন্য অস্ত্র পরিবহন করছিল। এছাড়া, সুদানি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জানান, আমিরাত কর্তৃক নির্মিত একটি ফিল্ড হাসপাতাল, যা বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত, আরএসএফের জন্য প্রধান সরবরাহ ও সহায়তা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। এমনকি চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত চাদ থেকে সামরিক সহায়তা নিয়ে ফ্লাইটগুলো আসছিল।

সুদানের আইনজীবীরা আদালতে উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানুয়ারিতে ঘোষণা করেছে যে, আমিরাতে অবস্থিত আরএসএফের মালিকানাধীন সাতটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র আরএসএফ বিদ্রোহীদের গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ করে।

তবে, আমিরাত আন্তর্জাতিক আদালতে জানায়, তাদের দেশে এই সাতটি কোম্পানির কোনো সক্রিয় ব্যবসায়িক লাইসেন্স নেই এবং বর্তমানে তারা কোনো কার্যক্রমও পরিচালনা করছে না।

এছাড়াও, সুদানের পক্ষ থেকে ইয়েল হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাবের একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়। এই গবেষণায় চীনের তৈরি ১৫৫ মিমি হাউইটজার আর্টিলারি গানের মতো ভারী অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ধরনের অস্ত্র কেনার একমাত্র দেশ হলো আমিরাত। গত ডিসেম্বরে জামজাম ক্যাম্পে ১২ দিনের বোমা হামলায় এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।

আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আমিরা আল-হেফাইতি আদালতের কাছে জানান, আমিরাত কোনো পক্ষকেই অস্ত্র সরবরাহ করেনি। রিম কেটাইত বলেন, আমিরাত এই যুদ্ধকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অভ্যন্তরীণ সংঘাত হিসেবে মনে করে। তিনি সুদানি সরকারকে আমিরাতের মধ্যস্থতার প্রস্তাবগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইনজীবী অ্যালিসন ম্যাকডোনাল্ড আদালতে জানান, সুদানের পক্ষ থেকে অস্ত্র সরবরাহের যে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, তা দুর্বল, পুরোনো অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি আরও জানান, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরবর্তী প্রতিবেদনে (যা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে) সুদানের দাবির পক্ষে কোনো সমর্থন পাওয়া যাবে না। তবে, বিশেষজ্ঞদের প্যানেল আমিরাত থেকে চাদে পাঠানো অস্ত্রের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছে কিনা, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *