সালসা সঙ্গীতের রানী সেলিয়া ক্রুজের জন্মশতবার্ষিকী: সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের গল্প।
সঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় নক্ষত্র, কিউবার গর্ব সেলিয়া ক্রুজের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। লাতিন সঙ্গীতের জগতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যিনি “কুইন অফ সালসা” (Salsa) নামে পরিচিত। তাঁর কণ্ঠের জাদু, সঙ্গীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাবের জন্য তিনি আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছেন।
সেলিয়া ক্রুজের জন্ম ১৯২৫ সালে, হাভানা, কিউবায়। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। ১৯৫০-এর দশকে ‘লা সোনোরা মাতানসেরা’ নামক একটি জনপ্রিয় ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি পেশাদার সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। তাঁদের গানগুলি কিউবার সোনালী দিনের সঙ্গীতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
কিন্তু ১৯৫৯ সালে কিউবান বিপ্লবের পর সবকিছু বদলে যায়। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর সরকার ক্ষমতা দখলের পর, সেলিয়ার সঙ্গীতজীবন নতুন মোড় নেয়। বিপ্লবী সরকার রেডিওতে তাঁদের নাচের গান প্রচার বন্ধ করে দেয়, কারণ ক্যাস্ট্রোর সরকার সেগুলিকে বিপ্লবী আদর্শের পরিপন্থী মনে করত। সেলিয়া ক্রুজ এবং তাঁর ব্যান্ড দল একসময় কিউবা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বিপ্লবের পর সেলিয়া ক্রুজ এবং তাঁর ব্যান্ড দল কিউবা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। প্রবাসের জীবন তাঁর জন্য সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বরং, এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা ধরে রেখেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি একক শিল্পী হিসেবে নতুন করে পথচলা শুরু করেন। এই সময়ে, তিনি নিউইয়র্কের স্প্যানিশ হারলেমের বিখ্যাত শিল্পী টিটো পুয়েন্তের সাথে কাজ করেন।
সেলিয়ার সঙ্গীতজীবন নতুন মোড় নেয় যখন তিনি ফানিয়া রেকর্ডসের সাথে যুক্ত হন। এই রেকর্ড কোম্পানিটি সালসা সঙ্গীতকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তোলে। সেলিয়ার “কুিম্বারা” (Quimbara) এবং “বেম্বা কালার” (Bemba Colorá)-এর মতো গানগুলি সালসা সঙ্গীতের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তাঁর “আজুকার!” (Azucar!)—”চিনি!”—এই বিখ্যাত চিৎকারটি তাঁর সঙ্গীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে এবং সারা বিশ্বে তাঁর পরিচিতি বাড়িয়ে তোলে।
সেলিয়া ক্রুজ শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নারী। সঙ্গীতের জগতে পুরুষদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর গানগুলোতে তিনি নিজের সংস্কৃতি, শিকড় এবং আত্মপরিচয়ের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
সেলিয়া ক্রুজ তাঁর সঙ্গীত জীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। তিনি তিনটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড এবং চারটি ল্যাটিন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সম্মানে নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, মিয়ামি সহ বিভিন্ন শহরের চাবি উৎসর্গ করা হয়েছে। সম্প্রতি, তিনি প্রথম আফ্রো-ল্যাটিনা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ সেন্টের কয়েনে স্থান করে নিয়েছেন।
আজও, সেলিয়া ক্রুজের সঙ্গীত বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতশিল্পীদের অনুপ্রাণিত করে। কার্ডি বি, ব্যারি কান্ট সুইম-এর মতো আধুনিক শিল্পীরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাঁর গানগুলো নতুন করে রি-ইস্যু করা হচ্ছে এবং তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে।
সেলিয়া ক্রুজের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাধ্যমে, আমরা তাঁর সঙ্গীত এবং তাঁর জীবন থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণাগুলো স্মরণ করি। তিনি প্রমাণ করেছেন, সঙ্গীত মানুষকে একত্রিত করতে পারে, কষ্ট ভুলে হাসতে শেখায় এবং জীবনের পথে অবিচল থাকতে সাহায্য করে।
তথ্য সূত্র: The Guardian