গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত তরুণ ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসাউনা। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাঁর। যুদ্ধের বিভীষিকা ক্যামেরাবন্দী করা এই সাহসী নারীর জীবনাবসান হলো ইসরায়েলি বিমান হামলায়। খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
২৫ বছর বয়সী ফাতিমা হাসাউনা গাজায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ক্যামেরাবন্দী করে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। গত ১৮ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত হওয়া, আপনজনদের মৃত্যু—এসব ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি।
তাঁর ভাষায়, ‘আমি যদি মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুটা যেন হয় শব্দমুখর। খবর হওয়ার মতো একটা মৃত্যু চাই আমি। এমন মৃত্যু, যা সময়ের সঙ্গে মিশে যাবে না, বরং কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।’
কিন্তু বুধবার, বিয়ের কয়েক দিন আগে উত্তর গাজায় নিজ বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন ফাতিমা। তাঁর পরিবারের আরও ১০ জন সদস্যও নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিলেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা বোনও। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হামাস যোদ্ধাদের ওপর চালানো একটি সুনির্দিষ্ট অভিযানের অংশ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ফাতিমার মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা আগেও একটি খবর আসে। তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার কথা ছিল। ‘পুট ইউর সোল অন ইয়োর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’ (Put Your Soul on Your Hand and Walk) নামের এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন ইরানি পরিচালক সেপিদেহ ফারসি। চলচ্চিত্রটি গাজার মানুষের দুর্ভোগ এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবন ফুটিয়ে তোলে। ফাতিমা ও ফারসির মধ্যে ধারণ করা কথোপকথনের মাধ্যমে এটি নির্মিত হয়েছে।
পরিচালক ফারসি জানান, ফাতিমা ছিলেন গাজায় তাঁর ‘চোখ’। তাঁর হাসি, কান্না, আশা এবং হতাশা—সবকিছুই তিনি ক্যামেরাবন্দী করেছেন। ফারসি আরও বলেন, ‘ফাতিমা ছিলেন উজ্জ্বল এক আলো, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী।
ছবিটি দেখলে আপনারা তা বুঝতে পারবেন।’ তিনি সবসময় ফাতিমার জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন, ফাতিমা যখন ভীত নন, তখন তাঁরও ভীত হওয়ার কোনো অধিকার নেই।
গাজায় সাংবাদিকদের জন্য ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত বছর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে ১৭০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কোনো কোনো হিসাবে এই সংখ্যা ২০৬ পর্যন্ত।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৫১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু।
মার্চ মাসে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েল আবারও বিমান হামলা জোরদার করেছে। শুক্রবারের হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন।
গাজায় কর্মরত সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ বলেন, ‘বোমা ও গুলির মধ্যে ফাতিমা তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। মানুষের কষ্ট ও আর্তনাদ তাঁর ছবিতে ধরা পড়েছে।’ গাজার আরেক সাংবাদিক মিকদাদ জামিল তাঁর ছবিগুলো দেখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ফাতিমার মৃত্যুতে কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ শোক প্রকাশ করেছে। তাঁরা জানান, ‘আমরা এমন একটি চলচ্চিত্রের সাক্ষী হতে যাচ্ছি, যেখানে এই তরুণীর জীবন যেন এক অলৌকিক ঘটনা।’
তাঁরা আরও বলেন, ‘তাঁর হাসি ছিল জাদুকরী, আর তাঁর দৃঢ়তা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। বোমার মধ্যে খাবার বিতরণ করা, শোক প্রকাশ করা—আমরা তাঁর গল্প শুনেছি, তাঁর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দিত হয়েছি, এবং তাঁর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলাম।’
গাজার ফিলিস্তিনি কবি হায়দার গাজালি জানান, মৃত্যুর আগে ফাতিমা তাঁর জন্য একটি কবিতা লিখতে বলেছিলেন। কবিতায় ফাতিমার পরকালের শান্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান