যেন এক দুঃস্বপ্ন! পাহাড়ের আগুনে সবকিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষদের করুন কাহিনী!

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি অগ্নিকাণ্ডের শিকার মানুষেরা যেন এক ধরনের ‘দৃষ্টির আড়ালে’ পরে গেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানলের ঘটনার তুলনায় তাদের জন্য সরকারি সাহায্য সেভাবে পৌঁছায়নি।

নভেম্বরে ভেন্টুরা কাউন্টিতে ‘মাউন্টেন ফায়ার’ নামক অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাসিন্দাদের এই দুর্দশা।

গত নভেম্বরে সংঘটিত হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডে ১৮২টি বাড়ি এবং অন্যান্য কাঠামো ভস্মীভূত হয়। কিন্তু ফেডারেল সরকার এটিকে বড় ধরনের দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা না করায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (FEMA)-এর সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্তরা যে ধরনের সহায়তা পেয়েছেন, ভেন্টুরার বাসিন্দারা তা থেকে বঞ্চিত। সাহায্য এবং পুনর্বাসনের জন্য সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত অর্থও আসেনি।

হ্যাটম নাইম নামের একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি জানান, তার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি সেই সহায়তা পাননি যা লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দারা পেয়েছেন। “আমাদের কাছে এটা একটা দুর্যোগ, কারণ আমরা সবকিছু হারিয়েছি,” – বলেন তিনি।

এই অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপক, আইনি সহায়তা বা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো কর্মসূচি নেই। জরুরি জিনিসপত্র কেনার জন্য দ্রুত নগদ অর্থ সহায়তা, অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা অথবা বাড়ি মেরামতের জন্য আর্থিক সাহায্য পাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

এমনকি পাসপোর্ট পুনর্গঠন বা ফেডারেল ট্যাক্স ফাইল করার সময়সীমা বাড়ানোর মতো সাধারণ সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

“আমরা অনেকটা বিস্মৃত হয়ে গেছি,” – জানান কিথ ম্যাকনেট, যিনিও এই অগ্নিকাণ্ডে তার বাড়ি হারিয়েছেন।

ভেন্টুরা কাউন্টির প্রায় সাড়ে আট লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নেই বলে সেখানকার কর্মকর্তা ও বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থার নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ভেন্টুরা কাউন্টি লং-টার্ম ডিজাস্টার রিকভারি গ্রুপের সমন্বয়ক অ্যান হোয়াটলি বলেন, “যেসব দুর্যোগে খুব বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হয় না, সেগুলো মোকাবিলা করা কঠিন। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত সম্পদ থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি FEMA-র কাঠামো পরিবর্তন করেন, তবে এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়া সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ইতিমধ্যে, ভেন্টুরা কাউন্টি লং-টার্ম ডিজাস্টার রিকভারি গ্রুপ, ইন্টারফেস ২১১ ভেন্টুরা কাউন্টি এবং ভেন্টুরা কাউন্টি কমিউনিটি ফাউন্ডেশন (VCCF) ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৭৫০ জন মানুষকে সহায়তা করার চেষ্টা করছে। তারা জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য পরিবার প্রতি সর্বোচ্চ ২,৭৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিতরণ করেছে।

তবে দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ভেন্টুরা কাউন্টি কমিউনিটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ভানেসা বেচটেল বলেন, “পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় দাতব্য অনুদান খুবই সামান্য।

২০১৭ ও ২০১৮ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ফাউন্ডেশন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বাড়ি পুনর্গঠনের জন্য সর্বোচ্চ ৭৫,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত সহায়তা করেছিল। এবার তারা অনুদানদাতাদের অনীহা এবং মনোযোগের অভাবের সঙ্গে লড়ছে।

বেচটেল আরও বলেন, “FEMA-র সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য আমরা যা করেছি, তার থেকে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

লস অ্যাঞ্জেলেসের অগ্নিকাণ্ডের পর এখানকার ভাড়ার বাজার আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সাহায্যকারীরা পরিবারগুলোকে জামানত এবং প্রথম মাসের ভাড়ার জন্য সাহায্য করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।

হোয়াটলি বলেন, “আবাসনের জন্য যা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম আগের চেয়ে অনেক বেশি।

ফেডারেল সহায়তা না থাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। হোয়াটলি লস অ্যাঞ্জেলেসে সক্রিয় জাতীয় অলাভজনক সংস্থাগুলোকে সেখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।

পুনর্গঠনের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে। হাতম নাইম পুনর্গঠনের জন্য স্মল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (SBA) থেকে ৬ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন। বার্ষিক ১৯,০০০ ডলার প্রিমিয়াম দেওয়ার পরে তিনি তার বীমা পলিসি বাতিল করেছেন।

তার ভাষায়, “আমি যদি তাদের ১৯,০০০ ডলার দিই, তাহলে তারা সম্ভবত সেটা বাড়িয়ে ৪০,০০০ ডলারে নিয়ে যেত।

ক্যালিফোর্নিয়ার শেষ আশ্রয় বীমাকারী প্রতিষ্ঠান, FAIR প্ল্যানের অধীনে তার প্রিমিয়ামও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। হাতম নাইম বলেন, “আমরা টাকা দিতে চাইনি, কারণ আমরা ভেবেছিলাম, পরের বছর এটা দ্বিগুণ হবে।” তাই তিনি আগুন লাগার চার মাস আগে বীমা বাতিল করেন।

বীমা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় ২০২০ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার মানুষ FAIR প্ল্যানের অধীনে বীমা করেছেন, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি পর্যাপ্ত বীমা কভারেজ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শ্রমিক ও নির্মাণ সামগ্রীর আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন।

মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে বলে ম্যাকনেট দম্পতি আশঙ্কা করছেন। র‍্যাচেল ম্যাকনেট বলেন, “আমি সবার জন্য দুঃখিত, তবে এটা আমাদের জন্য নতুন একটি উদ্বেগের বিষয়।

সাবেক FEMA কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্থাটির পক্ষে প্রতিটি দুর্যোগে সহায়তা করা সম্ভব নয়। প্রাক্তন FEMA প্রশাসক পিটার গেইনর বলেন, “তাহলে আমরা একটি জাতি হিসেবে দেউলিয়া হয়ে যাব।

তিনি আরও জানান, প্রতি চারটি দুর্যোগের মধ্যে একটিকে ফেডারেল সরকার সহায়তা করে। এর কারণ হলো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজ্য ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য করার সক্ষমতা।

ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথা বলেছেন। একইসঙ্গে রাজ্যের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি সহায়তা কর্মসূচি তৈরি করার জন্য অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

তথ্যসূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *