প্রাচীন মায়া সভ্যতার কেন্দ্রে, শিশুদের হাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি ১,৬০০ বছরের পুরনো বেদি আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। এটি মধ্য আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মানব আত্মত্যাগের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
গবেষকদের মতে, এই আবিষ্কার মায়া সভ্যতার তিকালে তেওতিহুয়াকান নামক এক শক্তিশালী সংস্কৃতির প্রভাবের প্রমাণ।
গবেষণাটি চালানো হয় গুয়াতেমালার তিকালের ধ্বংসাবশেষে। এখানে প্রাপ্ত বেদিটি সম্ভবত মানব আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।
বেদীর চারপাশে শিশুদের কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গেছে, যা এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টিফেন হাউস্টন এবং তার সহকর্মীরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন।
তাঁদের মতে, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে একসময় তিকাল তেওতিহুয়াকানের শাসকদের দ্বারা শাসিত হতো।
আর্টিকেলটিতে বলা হয়েছে, “স্থানীয় মায়া রাজবংশ টিকে ছিল, তবে তারা ছিল বিদেশি একটি গোষ্ঠীর অধীনে।” প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, বেদিটি সম্ভবত বলিদানমূলক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো এবং সেখানে সমাধিস্থ হওয়া ব্যক্তিরা সম্ভবত এই উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয়েছিল।
শিশুদের আত্মত্যাগ, সমাধিস্থলের শিল্পকর্ম এবং বেদীর চিত্রগুলি তেওতিহুয়াকানের দিকে ইঙ্গিত করে।
ঐতিহাসিকদের মতে, তেওতিহুয়াকান সম্ভবত বাণিজ্যিকভাবে তিকালের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, কিন্তু এই আবিষ্কার সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
হাউস্টনের মতে, “এতে আগ্রাসী এবং সহিংস প্রকৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়।”
জানা যায়, তেওতিহুয়াকান ছিল বর্তমান মেক্সিকোতে অবস্থিত একটি শক্তিশালী সভ্যতা। তিকালের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি পবিত্র স্থানে, তেওতিহুয়াকানের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাস করতেন বলে ধারণা করা হয়।
লাইডার (Laser Detection and Ranging) প্রযুক্তির মাধ্যমে ধ্বংসাবশেষের অনুসন্ধানে তেওতিহুয়াকানের স্থাপত্যশৈলীর অনুরূপ ভবনগুলিও খুঁজে পাওয়া গেছে, যার মধ্যে একটি বিশাল পিরামিড আকৃতির মন্দিরও রয়েছে।
এই আবিষ্কার তিকালের উপর তেওতিহুয়াকানের শাসন বা আক্রমণের তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করে। প্রাথমিকভাবে, তিকাল এবং তেওতিহুয়াকানের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, যা সম্ভবত মায়া অঞ্চলে গুপ্তচরবৃত্তির একটি কৌশল ছিল।
হাউস্টনের মতে, তিকাল ছিল “সোনার দেশ”, যেখানে প্রচুর সম্পদ ছিল, যেমন সুন্দর পালকের পোশাক এবং চকলেট।
পেন মিউজিয়ামের মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা গ্যালারির কিউরেটর, সাইমন মার্টিন মনে করেন, তেওতিহুয়াকানের শাসন সম্ভবত স্থানীয় কিছু মানুষের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আগের শাসনের বিরুদ্ধে ছিল।
তিনি আরও বলেন, তিকালের এলাকাটি “প্রধানত আনুষ্ঠানিক” ছিল এবং সেখানে তেওতিহুয়াকানের সামরিক উপস্থিতির তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আবিষ্কৃত বেদীর আশেপাশে পাওয়া কিছু পোড়া বস্তু, যেমন ধূপের বাটি, তেওতিহুয়াকানদের ক্ষমতা দখলের সময়কালের ইঙ্গিত দেয়। খননকালে ছয়জন মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে চারজন ছিল শিশু, যাদের বয়স ছিল দুই থেকে চার বছরের মধ্যে। সম্ভবত তাদের বলি দেওয়া হয়েছিল এবং বেদীর সামনে উপুড় করে পুঁতে রাখা হয়েছিল। তেওতিহুয়াকানে এ ধরনের বলিদান সাধারণ ছিল, কিন্তু তিকালে তা বিরল ছিল।
প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে একজনের সমাধিতে তেওতিহুয়াকান শৈলীর সবুজ রঙের একটি তীর পাওয়া গেছে। হাড়ের আইসোটোপ বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, এখানে শুধুমাত্র তেওতিহুয়াকান থেকে আসা ব্যক্তিদেরই বলি দেওয়া হয়েছিল।
বেদিটি প্রায় ৬ ফুট প্রশস্ত, ৪ ফুট গভীর এবং ৩ ফুটের বেশি উঁচু। এটি মাটি ও চুন দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং এর উপরে চুনকাম করা হয়েছিল।
এরপর লাল, কমলা, হলুদ এবং কালো রঙে এর চারপাশ সজ্জিত করা হয়েছিল। চিত্রগুলিতে তেওতিহুয়াকানের ঝড় ও যুদ্ধের দেবতার মুখ আঁকা ছিল।
হাউস্টন বলেন, “প্রাচীন চিত্রগুলি মাটির নিচে থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে বেদীর উপর তেওতিহুয়াকানের প্রভাব এখনো স্পষ্ট।”
মায়া লিপিগুলিও এই আবিষ্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই লিপিগুলিতে “পাঁচটি তুষারাবৃত আগ্নেয়গিরির দেশ”-এর উল্লেখ রয়েছে, যা সম্ভবত আধুনিক মেক্সিকো সিটির আশেপাশের আগ্নেয়গিরিগুলিকে নির্দেশ করে।
হাউস্টন বলেছেন, “তেওতিহুয়াকানের নিজস্ব কোনো সুস্পষ্ট লিখন পদ্ধতি ছিল না, তবে মায়া লিপি ব্যবহার করে তেওতিহুয়াকানের কেন্দ্রস্থলে কী ঘটছিল, তা বোঝা যায়।”
এই আবিষ্কার মায়া সভ্যতার ইতিহাস এবং প্রাচীনকালে তেওতিহুয়াকানের প্রভাব সম্পর্কে নতুন ধারণা দেয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সম্পর্কের আরও গভীরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।