মিয়ানমারে ভূমিকম্প: গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে কি পরিবর্তন আনবে?
গত মার্চ মাসে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল মিয়ানমার। এতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশটির জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। কিন্তু এই ভূমিকম্পের প্রভাব কি সেখানকার দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে? এমন প্রশ্ন এখন অনেকের মনে।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ভূমিকম্পের কারণে সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ এবং গোলাবারুদ তৈরির কারখানায় ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর তিন লিন আং-এর মতে, সৈন্যদের ব্যবহৃত কিছু গুলির মেয়াদ তাদের থেকেও পুরনো ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সৈন্যদের হাতে থাকা গোলাবারুদের সংকট দেখা দিয়েছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল সাগাইং অঞ্চলে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৩,৬৪৯ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজারের বেশি মানুষ, নিখোঁজ রয়েছেন ১৪৫ জন। ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি, কলকারখানা, বৌদ্ধ প্যাগোডা, অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাট এবং সেতু ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়া সেনাবাহিনী এখন শহরগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইছে।
তবে, ভূমিকম্পের কারণে ত্রাণ কার্যক্রমে সৈন্যদের অংশগ্রহণে ঘাটতি দেখা গেছে। এর সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (NUG) ভূমিকম্প কবলিত এলাকায় ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও, সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত ছিল। এনইউজি’র তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের পর থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান ও আর্টিলারি হামলায় অন্তত ৭২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। ১০ এপ্রিল, বিমান হামলায় ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীসহ আরও ২ জন নিহত হয়।
সাগাইং-এর একজন পিডিএফ যোদ্ধা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কিছু বিদ্রোহী ইউনিট ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নিলেও, সেনারা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। বিদ্রোহীদের ধারণা, এপ্রিল মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভূমিকম্পের কারণে সেনাবাহিনীর কৌশলগত কোনো পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। বিশেষ করে, ত্রাণ কার্যক্রমে তাদের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণের কারণে তাদের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে, পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে, যেখানে ভূমিকম্পের তেমন প্রভাব পড়েনি, সেখানে পরিস্থিতি আরও জটিল। এখানে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির (AA) সঙ্গে সেনাবাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে। আরাকান আর্মি একই সঙ্গে দেশটির মধ্যাঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই অঞ্চলের পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আরাকান আর্মির আনুমানিক ৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে এবং তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ পারদর্শী। পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যে, ভূমিকম্পের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বিদ্রোহীদের ধারণা, জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখালে আসন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ হবে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ভূমিকম্পের কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, দেশটির অনেক সামরিক কর্মকর্তা মনে করেন, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের শাসনের জন্য একটি খারাপ সংকেত। তারা এটিকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হারানোর পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের কর্তৃত্ব দুর্বল হতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়তে পারে।
ভূমিকম্পের কারণে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে সম্ভবত রাজি হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিয়াও হান হ্লাইং বলেছেন, ভূমিকম্পের কারণে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হয়তো দুর্বল হবে। তবে, সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের নিয়ন্ত্রণ এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা এখনো অনেক বেশি।
সব মিলিয়ে, ভূমিকম্প সম্ভবত মিয়ানমারের ক্ষমতা কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে না, তবে এটি সেনাবাহিনীর দুর্বলতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা