আতঙ্কের জাল! মনোবিজ্ঞানী সেজে মিডিয়াকে যা করলেন, শিউরে উঠবেন!

শিরোনাম: ‘বিশেষজ্ঞ’ পরিচয়ে বিভ্রান্তি: পশ্চিমা গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের বিস্তার, বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

গত কয়েক বছরে, পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে পরিচিত একজন ব্যক্তির যোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। বারবার সংবাদ মাধ্যমে উদ্ধৃত হওয়া এই ব্যক্তির নাম বারবারা সানতিনি।

তিনি মূলত একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং কোভিড পরিস্থিতি, ভিটামিন ডি-এর গুরুত্ব, এমনকি কীভাবে ডার্ট খেলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এমন নানা বিষয়ে মতামত দিয়েছেন।

কিন্তু সম্প্রতি তার দেওয়া এইসব মন্তব্য সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কারণ, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পরিচয় নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের অভাবে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম হয় তার সাক্ষাৎকারযুক্ত পুরো নিবন্ধটি বাতিল করেছে, না হয় তার দেওয়া মন্তব্যগুলো সরিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সানতিনি নামের এই ব্যক্তিটি আসলে কি কোনো সাজানো চরিত্র?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা সংবাদ সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা। কারণ, বর্তমানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ খুব সহজেই ভুয়া বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারে এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে।

সানতিনি বিভিন্ন সময়ে ভোগ (Vogue), মেট্রো (Metro), কসমপলিটন (Cosmopolitan), দ্য আই নিউজপেপার (The i newspaper), দ্য এক্সপ্রেস (The Express), হ্যালো! (Hello!), দ্য টেলিগ্রাফ (The Telegraph), ডেইলি স্টার (The Daily Star), ডেইলি মেইল (The Daily Mail) এবং দ্য সান (The Sun)-এর মতো সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন।

এমনকী বিবিসি-র আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটেও তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সানতিনি মূলত ‘পিসেস অ্যান্ড স্ক্রিমস’ নামক একটি অনলাইন সেক্স টয় বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।

সেখানে তিনি সেক্স এবং সম্পর্ক বিষয়ক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। তার ওয়েবসাইটে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী এবং সেক্স অ্যাডভাইজার’ পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

যদিও, ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটি (BPS) জানিয়েছে, তিনি তাদের সদস্য নন। তার কোনো সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলও নেই।

তবে ব্লগিং সাইট মিডিয়ামে তার দুইজন ফলোয়ার রয়েছে।

এই বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলে প্রেস গেজেট (Press Gazette)। বিষয়টি নিয়ে ‘পিসেস অ্যান্ড স্ক্রিমস’-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে, গার্ডিয়ান (The Guardian) পত্রিকা সানতিনিকে তার পরিচয় এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিতে বলে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অবশেষে একটি বার্তা পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়, ‘এই বিষয়ে আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ’। এরপর আর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

যেসব সাংবাদিক সানতিনিকে উদ্ধৃত করেছেন, তাদের অনেকে জানিয়েছেন, তারা এমন কিছু সংস্থার মাধ্যমে তার মন্তব্য পেয়েছেন, যারা বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিকদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

এর মধ্যে একটি হলো রেসপন্সসোর্স (ResponseSource)। এই সংস্থাটি বর্তমানে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং সানতিনিকে প্রতিনিধিত্ব করা জনসংযোগ সংস্থাকে (PR agency) বরখাস্ত করেছে।

তারা এখন একটি পিয়ার রিভিউ সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনা করছে, যার মাধ্যমে সাংবাদিকরা বিশেষজ্ঞদের রেটিং করতে পারবেন।

এছাড়াও, কুইওটেড (Qwoted) নামক আরেকটি প্ল্যাটফর্মেও সানতিনীর একটি প্রোফাইল ছিল। তবে তার উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় সেটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ডেইলি মিরর, ডেইলি এক্সপ্রেস এবং ডেইলি স্টার-এর মালিকানা সংস্থা রিচ (Reach)-ও তাদের কভারেজ থেকে সানতিনীর মন্তব্য সরিয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যে ডেইলি স্টারের একটি নিবন্ধে সানতিনি বলেছিলেন, কীভাবে ডার্ট খেলার মাধ্যমে পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি এবং সমস্যা সমাধানের মতো গুণাবলী বৃদ্ধি করা যায়।

ডেইলি মিররের একটি প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, কোভিড অতিমারীর কারণে কিছু মানুষের নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছে, তারা সহজে উত্তেজিত হচ্ছেন এবং সামাজিক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলছেন।

গার্ডিয়ান পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকেও তার মন্তব্য সরিয়ে নিয়েছে।

বিবিসি-ও বিবিসি ফিউচার (BBC Future)-এর একটি প্রতিবেদনে, যা বিবিসি ডটকম (BBC.com)-এর জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেখান থেকে সানতিনীর মন্তব্য সরিয়েছে।

বিবিসির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘বারবারা সানতিনীর উদ্ধৃতিগুলি বিবিসি ফিউচারের পক্ষ থেকে ভালো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল।

যদিও নিবন্ধের বিষয়বস্তু এখনো সঠিক, এবং তার অবদান সামান্য ছিল, তবে আমরা সানতিনীর প্রমাণ যাচাই করতে পারিনি বলে তার মন্তব্যগুলি সরিয়ে দিয়েছি।’

এই ঘটনা প্রমাণ করে, ডিজিটাল যুগে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সাংবাদিকদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষ করে যখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (AI) দৌলতে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো সহজ হয়ে গেছে।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস-এর জার্নালিজম অ্যান্ড এআই প্রকল্পের প্রধান চার্লি বেকেট বলেন, ‘আসলে, সাংবাদিকদের ওপর দ্রুত খবর পরিবেশন করার যে চাপ রয়েছে, এটি তারই ফল।

এখানে AI-এর কোনো দোষ নেই, দোষটা হলো কিছু অসাধু মানুষের।’

ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির (BPS) প্রেসিডেন্ট রোমান রাজকা বলেন, ‘ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির মতো একটি পেশাদার সংস্থার সঙ্গে কাজ করলে সকল সাংবাদিক নিশ্চিত হতে পারেন যে, তারা একজন প্রকৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন।’

এই ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়।

তথ্য সূত্র: The Guardian

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *