ওকলাহোমা সিটি বোমা হামলার ৩০ বছর পর, ‘অলৌকিক শিশু’ পিজে অ্যালেন-এর জীবন: শোক আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
১৯৯৫ সালের ১৯শে এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ বোমা হামলায় কেঁপে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। আলফ্রেড পি. মুররাহ ফেডারেল বিল্ডিং-এ চালানো সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৬৮ জন, যাদের মধ্যে ১৯ জন ছিল শিশু।
সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি আজও তাড়িয়ে ফেরে অনেকের মনে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই যেন ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যায়। এই ঘটনার শিকার শিশুদের মধ্যে একজন ছিলেন পিজে অ্যালেন।
বোমা হামলায় গুরুতর আহত হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এই শিশুর জীবন নতুন করে শুরু হয়, যা আজও অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা।
বোমা হামলায় আহত হওয়ার সময় পিজের বয়স ছিল মাত্র ১৮ মাস। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মকভাবে ঝলসে গিয়েছিল।
হাসপাতালে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এতটাই ব্যান্ডেজ দিয়ে শরীর ঢাকা ছিল যে, তার মা-বাবা শুরুতে তাকে চিনতেই পারেননি। পরে তার শরীরের একটি বিশেষ চিহ্ন দেখে পিজের দিদিমা ডেলোরিস ওয়াটসন তাকে শনাক্ত করেন।
ডেলোরিস জানান, তিনি প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালে তার নাতিকে ডে-কেয়ারে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই ঘটে সেই বিভীষিকা।
আমি আমার শিশুকে চিনি
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন ডেলোরিস। হাসপাতালে উপস্থিত কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি ওকে ডায়াপার পরাতাম, পাউডার দিতাম, স্নান করাতাম। আমি আমার বাচ্চার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি চিনি।
পিজে অ্যালেন ছিলেন সেই শিশুদের মধ্যে একজন, যারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন।
বোমা হামলার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন পিজে। শরীরে পোড়ার দাগ, হাড় ভেঙে যাওয়া, ফুসফুসের ক্ষতি, মাথার আঘাত, এমনকি কণ্ঠনালীরও ক্ষতি হয়েছিল তার।
ছোটবেলায় তাকে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হতো। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করার জন্য তার গলায় একটি নল লাগানো ছিল।
আজও শ্বাসকষ্ট হয়, কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার না মানা পিজে মনে করেন, “আমি এখনো বেঁচে আছি, এটাই অনেক।
পিজের দিদিমা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা সবসময় চেষ্টা করেছেন, যাতে পিজে-র শৈশব আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই কাটে। তাকে বেসবল এবং বাস্কেটবল খেলতে উৎসাহিত করা হতো।
হামলার ঘটনার কথা যেন তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হতো।
বর্তমানে, পিজে অ্যালেন ওকলাহোমা সিটির টিনকার এয়ার ফোর্স বেসে একজন বিমান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি সামরিক বিমানের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা মেরামতের কাজ করেন।
জীবনের কঠিন দিনগুলো পেরিয়ে এসে তিনি উপলব্ধি করেছেন, “আমাদের সবারই বেঁচে থাকার একটা কারণ আছে। সেই কারণ খুঁজে বের করাই হলো জীবনের আসল উদ্দেশ্য।
অন্যদিকে, এই হামলায় দুই ছেলেকে হারানো মা এডি রেইনস-এর জীবনে নেমে এসেছিল গভীর শোকের ছায়া। তার দুই ছেলে, ৩ বছর বয়সী চেজ এবং ২ বছর বয়সী কোলটন-কে তিনি সেদিন ডে-কেয়ারে রেখে এসেছিলেন।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। “আমি ভেবেছিলাম, সেদিনটা আমার জীবনের সেরা দিন হতে যাচ্ছে”, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন এডি।
তিনি আজও তার সন্তানদের স্মৃতিচারণ করেন।
ওকলাহোমা সিটি ন্যাশনাল মেমোরিয়াল অ্যান্ড মিউজিয়াম এই ঘটনার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং আহতদের আরোগ্য লাভের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
নিহতদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছে ‘ফিল্ড অফ এম্পটি চেয়ারস’, যেখানে ১৬৮টি ব্রোঞ্জ ও গ্রানাইটের চেয়ারে প্রতিটি মৃতের নাম খোদাই করা আছে।
যে কোনো ধরনের সহিংসতা যে কখনোই কোনো সমাধান নয়, তা বোঝানোর জন্য এই মেমোরিয়াল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই ঘটনা আমাদের শিখিয়ে যায়, শোককে কীভাবে সঙ্গী করে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে হয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন